Tuesday 12 April 2016

Ceriops decandra (ঝামটি গরান)

Ceriops decandra
ঝামটি গরানের বৈজ্ঞানিক নাম Ceriops decandra। গ্রীক শব্দ Decandra’র অর্থ ‘দশজন পুরুষ’। এটিকে বাংলায় জাইলা গরান, গুট্টিয়া বা গুটাইয়াও বলা হয়। ঝামটি গরানের ফুলে ১০ থেকে ১২টি পুংকেশর থাকে বলেই হয়তো দ্বিপদী নামে Decandra শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে [১]। বাদাগাছের যতোগুলো মূখ্য প্রজাতি আছে গরান তার মধ্যে অন্যতম। এ গাছের ফুল থেকে অনেক মধু পাওয়া যায়। গন্ধ ও স্বাদের কারণে গরান ও খলসি (Aegiceras corniculatum) ফুলের মধুর সুখ্যাতি আছে।

ঝামটি গরান একটি ছোট গাছ বা গুল্ম। কয়েকটি গরান গাছ গাদাগাদি করে জন্মায় বলে বনজীবীরা ‘গরানের ঝাড়’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। একহারা লম্বা ঝামটি গরানের কাণ্ড উপকূলীয় এলাকায় ঘরের বারান্দার খুঁটি, চালের কাঠামো বা জ্বালানি কাঠের কাজে ব্যবহার করে থাকেন [২]

Ceriops decandra
বিবরণ
ঝামটি গরান একটি চিরসবুজ, মাঝারি আকৃতির, সরু, সোজা, ধীর বর্ধনশীল ও বহুবর্ষজীবী গুল্ম যা মাত্র ১.৫ থেকে ৪ মিটার লম্বা হয়। গাছের চারদিক ছড়িয়ে সরু ডালপালা হয়। কাণ্ডটাও সরু। সরু হলে কী হবে, ঝামটি গরান গাছের কাণ্ড কিন্তু খুবই শক্ত এবং নোনাপানিতে টিকে থাকার জন্য প্রচুর কার্বন ধরে রাখে। এ কারণে এ গাছের কাঠ বহু বছর নষ্ট হয় না। কাদা ও নোনাপানির মধ্যে বেড়ে উঠতে হয় বলে ঝামটি গরান গাছের চারপাশে অসংখ্য ঠেসমূল (stilt-root) থাকে। ঠেসমূলগুলোর গায়ে আবার বাতাস নেয়ার জন্য থাকে বায়ুমূল। মূল মাটির গভীরে প্রবেশ করে না। ঠেসমূলগুলো এমনভাবে থাকে যেন মনে হয়, ঠেসমূল একত্রিত হয়েই গাছটার জন্ম হয়েছে।

ঝামটি গরানের পাতা ৫-১০ সেমি লম্বা ও ২-৫ সেমি চওড়া। দেখতে অনেকটা ডিম্বাকার। পাতার গোড়ার দিকটা সরু এবং অগ্রভাগ গোলাকার তবে অগ্রভাগে খাঁজ আছে। অন্যান্য লাল ও কালোবাদা গাছের মতো ঝামটি গরানের পাতাও একটু পুরু কারণ লবণ-সহনশীল এসব গাছের প্রস্বেদনে প্রচুর শক্তিব্যয় করতে হয়। প্রস্বেদনের মাধ্যমে এ গাছ নিজের শরীর থেকে লবণ ছেঁকে ফেলে দেয়। সে কারণে ঝামটি গরানের পাতার তলদেশে শাদা রঙের লবণ দেখতে পাওয়া যায়। ঝামটি গরানের ফুল ছোট ও সুগন্ধময়। ফুলগুলো ০.৫ সেমি’র চেয়ে বড় হয় না [৩]। ফুল উভয়লিঙ্গ অর্থাৎ স্বপরাগায়নে সক্ষম। ফুল থেকে বাদামি রঙের ১.৫-২.০ সেমি মোচাকৃতির ফল হয়। ফলে একটিই মাত্র বীজ থাকে। এ গাছের ফুল থেকে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম হয় অর্থাৎ ফুল থেকে যে ফল হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই অঙ্কুরোদ্গম ঘটে যা জরায়ুজ অঙ্কুর (Propagule) নামে পরিচিত।

অনেক সময় অঙ্কুরটি গাছে থাকতেই শেকড় জন্মায়। ১০-১২ সেমি লম্বা অঙ্কুরটি মাঝখানে একটু মোটা হলেও প্রান্তভাগ সরু। এর ফলে গাছ থেকে অঙ্কুরটি খাড়া হয়ে মাটিতে পড়ে। এ গাছটি জন্মানোর স্থান যেহেতু কাদাময়, সেহেতু অঙ্কুরগুলো সোজা মাটিতে ঢুকে যায় এবং পলিবাহিত ঊর্বর মাটিতে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। এছাড়া এ অঙ্কুরগুলো খুবই হালকা। জোয়ার-ভাটার পানিতে পড়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় আরেক চর বা দ্বীপে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই সেখানে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় [৪]

বর্গ : Malpighiales, পরিবার : Rhizophoraceae, গণ : Ceriops, প্রজাতি : C. decandra
দ্বিপদী নাম : Ceriops decandra (Griff.) Ding Hou
সমনাম : Bruguiera decandra Griff., Ceriops candolleana Náves, Ceriops roxburghiana Arn.
উদ্ভিদের ধরন : চিরসবুজ গুল্ম (Evergreen Shrub)
আবাসস্থল : লবণাক্ত উপকূলের তুলনামূলকভাবে উঁচু ও অনিয়মিত প্লাবিত এলাকা
বাদাগাছের ধরন : মূখ্যবাদা, কালোবাদা
পাতার ধরন : সরল, প্রতিমুখ ও ডিম্বাকার, ৫-১০ সেমি লম্বা
ফুলের ধরন : ৫-৬টি পাপড়ি ও বৃত্যাংশ, ০.৫ সেমি দীর্ঘ
ফুল ও ফলের সময় : মার্চ থেকে মে পর‌্যন্ত ফূল ফোটে এবং এপ্রিল থেকে জুলাই পর‌্যন্ত ফল পাওয়া যায়
সংরক্ষণ পরিস্থিতি : প্রায় বিপদাপন্ন

আবাসস্থল
ঝামটি গরান পরিমিত থেকে উচ্চ লবণাক্ততা পর‌্যন্ত সব পর‌্যায়ের লবণাক্ততায় জন্মাতে ও বেড়ে উঠতে পারে। এ প্রজাতির গাছ অল্প জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে বলে সাধারণত তুলনামূলকভাবে উঁচু ভূমিতে জন্মায়। এ গাছের বসতি সুন্দরী গাছের বসতি এলাকার মতো পুরোপুরি শুকনো নয়, বরং ভেজা ও কাদায় ভরা। সাধারণত হরগজা (Acanthus ilicifolius), গেওয়া (Excoecaria agallocha), সুন্দরী (Heritiera fomes), গুরা বা রোহিণী (Kandelia candel) ও কেওড়া (Sonneratia apetala) গাছের সাথে বসতি ভাগাভাগি করে ঝামটি গরান গাছ জন্মায়

পরিব্যাপ্তি
অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ব্রুনেই দারুসসালাম, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মায়ানমার (বার্মা), সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বাদাবন এলাকায় ঝামটি গরান গাছ পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীতে গরান-আবৃত এলাকার আয়তন প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বর্গ কিমি। সুন্দরবন ছাড়াও বাংলাদেশের বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের উপকূলীয় এলাকায় এ গাছ পাওয়া যায় [৫]
Ceriops decandra


বৈজ্ঞানিক নাম ও সমনাম
ঝামটি গরানের বৈজ্ঞানিক নাম Ceriops decandra প্রথম চিহ্নিত করেন ব্রিটিশ ডাক্তার, নিসর্গী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম গ্রিফিথ (William Griffith) যাঁকে সংক্ষেপে Griff. নামে ডাকা হয়। গ্রিফিথের উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সূত্র ধরে ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভূত ওলন্দাজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী Ding Hou (1921-2008) এ নামকরণ করেন। Ceriops decandra-এর পুরো নাম হবে Ceriops decandra (Griff.) Ding Hou। এর অন্যান্য সমনামের মধ্যে রয়েছে: Bruguiera decandra Griff., Ceriops candolleana Náves ও Ceriops roxburghiana Arn. গরানের ৪টি প্রজাতি সারা পৃথিবীতে পাওয়া যায়। সেগুলো হলো : Ceriops australis, Ceriops decandra, Ceriops tagalCeriops zippeliana। এর মধ্যে বাংলাদেশে শুধুমাত্র Ceriops decandraCeriops tagal পাওয়া যায়। Ceriops tagal স্থানীয় জনসাধারণের কাছে মটগরান নামে পরিচিত।

স্থানীয় নাম
বাংলাদেশে ও ভারতে বাংলায় Ceriops decandra গরান, ঝামটি গরান বা জাইলা গরান নামেই পরিচিত। এছাড়া গুট্টিয়া বা গুটাইয়াও বলা হয়। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় Flat-Leaf Spurred Mangrove, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে টেঙ্গার (Tengar), কম্বোডিয়ায় স্মায়ে (Smae), ইংরেজিতে Spur Mangrove, Indian Mangrove বা Tagal Mangrove, ইন্দোনেশিয়ায় টেঙ্গার, পালুন বা বিডো-বিডো (Tengar, Palun or Bido-Bido), ফিলিপাইনে বারাস-বারাস (Baras-Baras) ও মালাটাঙ্গাল (Malatangal), মায়ানমারে (বার্মা) কা পেয়েং (Ka-Pyaing), ওড়িয়া ভাষায় গরানি বা গরলাহ (Garani or Garlah), সিংহলিজ (শ্রীলঙ্কা) ভাষায় কাদোল (Kadol), তামিল ভাষায় চিরু কান্দাল (Chiru Kandal), তেলেগুতে গাথারু (Gatharu), থাইল্যান্ডে কাপুলং, প্রংখাও বা সামায় মানোহ (Kapuulong, Prong Khaao or Samae Manoh) এবং ভিয়েতনামে জ্বা বা মাইরসর (Dza or Smairsor) বলা হয় [৬]

ব্যবহার
ঝামটি গরানের কাণ্ড সরু হলেও মজবুত। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় এলাকায় সাধারণ বাড়িঘরে বারান্দার খুঁটির জন্য এ গাছের কাণ্ড ব্যবহারের প্রচলন আছে। বর্ষা-কাদায় নষ্ট হয় না বলে এ গাছের কাণ্ড দিয়ে ঘরের চালের কাঠামো খুবই ভালো হয়। ছোট নৌকার কাঠামো (পাঁজরা) তৈরিতেও ঝামটি গরানের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কাঠি, লাঠি, ও জ্বালানি হিশেবেও এ গাছ ও ডালপালার ব্যবহার আছে। গরানের কাঠ পুড়িয়ে ভালো মানের কয়লা তৈরি হয়। জেলেরা খাল বা চরের চারদিকে জালের ঘেরা দেয়ার জন্য এ গাছের কাণ্ড ব্যবহার করে বলে নাম হয়েছে জালিয়া গরান।

দুই ধরনের গরানের মধুই সুগন্ধী, অত্যন্ত সুস্বাদু ও ভেষজ গুণসম্পন্ন। এজন্য বনজ মধুর মধ্যে গরানের মধুর চাহিদা ব্যাপক। ঝামটি গরানের বাকল ট্যানিনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। মাছ ধরার জাল পাকা করতে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। উপকূলীয় জেলেরা গরানের ছাল (বাকল) পানির জালার মধ্যে ভিজিয়ে বাকলের কষ বের করতো। তারপর কষ জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো জালের সুতো শক্ত করার উপকরণ। গরানের বাকলের রস থেকে কালো রঙ উৎপন্ন হয় যা পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত [৭]

প্রাচীনকাল থেকেই প্রথাগত চিকিৎসায় ঝামটি গরানের ব্যবহার আছে। বাকলের রস রক্ত পড়া বন্ধ করে। বাকলের রসের ক্বাথ রক্তস্রাব চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। চর্মরোগ, কুষ্ঠ ও ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় পাতার ব্যবহার আছে।

সংরক্ষণ পরিস্থিতি
আইইউসিএন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় (IUCN Red List) ঝামটি গরান ‘প্রায় বিপদাপন্ন’ (Near Threatened) হিশেবে চিহ্নিত। পুরোপুরি সঠিক হার না জানা গেলেও ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল - এই ২০ বছরে ঝামটি গরান-আবৃত বাদাবনের পরিমান ১২-২০ শতাংশ কমে গেছে। তিন প্রজন্মের (১২০ বছর) সঠিক উপাত্ত পাওয়া গেলে নিশ্চিতভাবেই এ প্রজাতিটি ‘বিপদাপন্ন’ তালিকার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে [৮]। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই ঝামটি গরান সংরক্ষণে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেই। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে বনজ সম্পদ হিশেবে অন্যান্য গাছের সঙ্গে গরান গাছের সংগ্রহ ও ব্যবহারের অনুমোদন প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্ববসতিতে রক্ষা করার জন্য আরো কার‌্যকর কর্মসূচি নেয়া দরকার।

অধিকতর পাঠ
Ceriops australis, Ceriops zippeliana, উইলিয়াম গ্রিফিথ (William Griffith), উচ্চ লবণাক্ততা (Hyper Salinity), উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জরায়ুজ অঙ্কুর (Propagule), ঠেসমূল (stilt-root), ডিং হৌ (Ding Hou), মটগরান (Ceriops tagal)


সংশ্লিষ্ট উপকরণ
- Customary Use of Mangrove Tree as a Folk Medicine among the Sundarbans Resource Collectors
- Global Forest Resources Assessment 2010: Country Reports - Bangladesh
- Medicinal and Aromatic Plants as Global Resources
- The Undergrowth Species of Sundarban Mangrove Ecosystem (Bangladesh)
- World Atlas of Mangroves 2010

তথ্যসূত্র 
(১) https://en.wikipedia.org/wiki/Ceriops_decandra
(২) হোসেন, মাহমুদ (২০১৫). সুন্দরবন বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বৃক্ষ পরিচিতি. জিআইজেড. ঢাকা : সেপ্টেম্বর ২০১৫. পৃ. ৩৬
(৩) http://eol.org/pages/3062587/overview
(৪) http://ecocrop.fao.org/ecocrop/srv/en/cropView?id=4434
(৫) http://amap-collaboratif.cirad.fr/pages_logiciels/Mangrove_web/especes/c/cerde/cerde.html
(৬) Ceriops decandra (Griff.) Ding Hou: http://globinmed.com/index.php?option=com_content&view=article&id=79163:ceriops-decandra-griffith-ding-hou&catid=367:c
(৭) রহমান, এম অলিউর (২০০৯). Ceriops decandra. In Ahmed, Z.U., Hassan, M.A., Begum, Z.N.T., Khondker, M., Kabir, S.M.H., Ahmad, M. and Ahmed, A.T.A (eds.). Encyclopedia of Flora and Fauna of Bangladesh, Vol. 10. Angiosperms: Dicotyledons (Balsaminaceae-Euphorbiaceae). Asiatic Society of Bangladesh. Dhaka. pp. 20-21
(৮) http://www.iucnredlist.org/details/178853/0


প্রদায়ক

Hasan Mehedi, Taposh BaruaKhasru Chowdhury