Saturday 9 April 2016

Caesalpinia bonduc (নাটা)

Caesalpinia bonduc
নাটা (Caesalpinia bonduc) গাছটিকে ইংরেজিতে গ্রে নিকার (Gray Nicker) বলে ডাকা হয়। সম্ভবত ওলন্দাজ শব্দ নিক্কার (knikker) থেকে ক্যারিবীয় nicker শব্দটা এসেছে যার অর্থ ‘কাদার গুঁটি’। ক্যারিবীয় অঞ্চলে ষোলগুঁটি বা আটগুঁটি খেলার মতো ওয়ারে (oware) নামক একটি পারিবারিক খেলায় গুঁটি হিশেবে নাটার বীজ ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হয়, এ কারণেই নাটার নাম ইংরেজিতে গ্রে নিকার হয়েছে। এটা একটা বাদা সহযোগী বা Mangrove Associate গাছ (১)। অর্থাৎ এই প্রজাতিটি বাদাবনের বাইরে মাঝারি লবণাক্ত পরিবেশে জন্মাতে পারে। মাঝারি মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে বলে এ গাছটিকে ‘কালোবাদা’ বা Black Mangrove-এর অন্তর্ভূক্ত করা হয় (২)। নাটা প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের উপকূল ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে জন্মায়। তবে, বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই নাটাগাছ দেখা যায়। এই গণের আরেকটি গাছ কুটুমকাঁটা বা Caesalpinia cristaও বাদাবনে (Mangrove Forest) পাওয়া যায়।

বিবরণ
-----------------------------
নাটাগাছ একটি বিশৃঙ্খলভাবে বাড়ন্ত গুল্ম বা ঝোপজাতীয় গাছ হলেও কখনও কখনও অন্য গাছের উপর ভর করেও বেড়ে ওঠে। ৫-৬ মিটার উচ্চতার গাছটির ৩০-৫০ সেমি লম্বা শাখায় যৌগিক পাতা হয়। প্রত্যেক একজোড়া পাতার গোড়ায় দুটি করে কাঁটা থাকে। কাঁটাগুলো পেছনমূখী হওয়ায় কোনো প্রাণীর গায়ে লাগলে সহজে ছাড়িয়ে আসতে পারে না। এভাবেই নাটাগাছ নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করে। ৬-৭ সেমি লম্বা ও ৩-৪ সেমি চওড়া চ্যাপ্টা ডিম্বাকৃতির ও হালকা সবুজ রঙের ফল হয়। ফলের গায়ে বড়শির মতো অসংখ্য কাঁটা থাকে। নাটার ফল পাকার পর শুকিয়ে ফেটে যায়। হঠাৎ করে এতো জোরে ফাটে যে বীজ গাছ থেকে অন্তত ২ মিটার দূরে গিয়ে পড়ে। এভাবে নাটাগাছ শুধু বংশবিস্তারই করে না, বরং নতুন নতুন এলাকা দখল করে নেয়। নাটার বীজ শালিকের ডিমের চেয়ে কিছুটা ছোট এবং ধূসর রঙের হয়। বংশবিস্তারে এদের দুটো বিরাট সুবিধা আছে, যা অন্যান্য গাছের নেই। প্রথমত, এদের বীজ ধূসর রঙের হওয়ায় সহজে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। ফলে বীজভূক পশুপাখি সহজে নাটার বীজ খুঁজে পায় না। আর দ্বিতীয়ত বীজ অত্যন্ত হালকা বিধায় জোয়ারভাটার স্রোতের সঙ্গে বহুদূর ভেসে যেতে পারে। ১৬৯৩ সালে স্কটল্যান্ডের মন্ত্রী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জেমস ওয়ালেস উল্লেখ করেন যে, সামুদ্রিক ঝড় ও স্রোতের সঙ্গে নাটার বীজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের উপকূলে চলে আসে (৩)। ১৭৫১ সালে ডেনমার্কের ইতিহাসবিদ এরিক পন্টোপিড্যানও নরওয়ের উপকূলে এ বীজ ভেসে আসার ঘটনা উল্লেখ করেছেন (৪)।
বর্গ : Fabales; পরিবার : Caesalpiniaceae; গণ : Caesalpinia; প্রজাতি : bonduc
উদ্ভিদের ধরন : গুল্ম বা ঝোপ
বসতি এলাকা : উপকূল বা উপকূলবর্তী ছোট ঝোপবিশিষ্ট জঙ্গল
বাদাগাছের ধরন : বাদা সহযোগী, কালোবাদা।
পাতার ধরন : যৌগিক পাতা, একসঙ্গে ৭-১২ জোড়া পাতা হয়। পাতা ২-৪ সেমি লম্বা, দীর্ঘ ডিম্বাকার। উপপত্র আছে।
ফুলের ধরন : হলদে ফুল হয়। পাঁচটি বৃত্যাংশ বা পাপড়ি থাকে।
ফুল ও ফল ধারণ : জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ফুল হয় এবং অক্টোবর থেকে জানুয়ারির মধ্যে ফল পেকে যায়।
আবাসস্থল
-----------------------------
উপকূলবর্তী মাঝারি মাত্রার (৫-১৮ পিপিটি) লবণাক্ত পরিবেশে নাটাগাছ জন্মাতে পারে (৫)। এরকম লবণাক্ত পরিবেশকে Mesohaline Zone বলা হয়। সামান্য লবণাক্ত বা লবণাক্ত নয় এমন সাধারণ পরিবেশেও এ গাছ জন্মায়। অনূর্বর বা সামান্য ঊর্বর জমিতেও নাটাগাছ বেড়ে উঠতে পারে। শস্যক্ষেত্রের সীমানা, পথের ধার এবং কখনও কখনও খালি জায়গায় ঘন ঝোপ আকারেও জন্মায়। বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই নাটাগাছ দেখা যায়।

পরিব্যাপ্তি
-----------------------------
পুরো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা জুড়ে নাটাগাছ ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, বার্মা (মিয়ানমার), চীন, কলাম্বিয়া, কমোরোস, কোস্টারিকা, কিউবা, ইথিওপিয়া, ইকুয়েডর, গ্যাবন, গিনি, ঘানা, ভারত, জ্যামাইকা, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নেপাল, নিকারাগুয়া, নাইজেরিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, পেরু, পুয়ের্তে রিকো, সিয়েরা লিওন, সিঙ্গাপুর, সোমোয়া, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, তানজানিয়া, টোঙ্গা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামে নাটাগাছ পাওয়া যায়।

বৈজ্ঞানিক নাম ও সমনাম
Caesalpinia bonduc
-----------------------------
নাটা’র বৈজ্ঞানিক নাম Caesalpinia bonduc, নামকরণ করেছেন William Roxburgh যাঁকে সংক্ষেপে Roxb. বলা হয়। তিনি Carl Linnaeus-এর প্রাথমিক শনাক্তিকরণ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে ১৮৩২ সালে এ গাছের নামকরণ করেন। নাটার বৈজ্ঞানিক নামের পূর্ণরূপ : Caesalpinia bonduc (L.) Roxb. (1832)। অন্যান্য নামগুলো হলো Bonduc minus Medik., Caesalpinia bonducella (L.) Fleming, Caesalpinia crista L., p.p.a, Caesalpinia cristata Prowazek, Guilandinia bonduc L. ও Guilandinia bonducella L.।

স্থানীয় নাম
-----------------------------
বাংলায় নাটা’র আরো কয়েকটি নাম প্রচলিত আছে। যেমন : কাঁটানাটা, নাটাকরঞ্জ, ঝাগরাগোটা বা লালকান্তা। নাটা গাছটিকে আরবিতে আকিত-মাকিত (akit-makit), অসমীয়তে লেটাগুঁটি (Letaguti), ক্যারিবীয় অঞ্চলে গ্রে নিকার (Gray Nicker), ইংরেজিতে Gray Nicker, Nicker Nut, Indian Nut, Benzoar Nut, Nickar Bean বা Physic Nut, ফারসিতে খায়াহে-ই-ইবলিস (khayahe-i-iblis), জার্মান ভাষায় কুগেলস্ট্রস (Kugelstrauch), হিন্দিতে কাঠকরঞ্জ (Kat Karanj), ইন্দোনেশিয়ায় আরেউজ (Areuj), আরুক (Aruk), বাগোরে (Bagoré), কানিকের (Kaniker) ও কুটুক (Kutuk), কানাড়ায়, গেজ্জুগা (Gejjuga), মালায়ালামে কাঝানচিক্কুরু (Kazhanchikkuru), মারাঠিতে সাগরগোটি (Sagargoti), উড়িয়ায় গিলো (Gilo), পর্তুগীজে নজ-ডি-বোনডাক (noz de bonduque), সংস্কৃতে দুস্পর্শ (Duhsparsa), কণ্টকি করঞ্জা (Kantaki karanja), বজ্র বীজাকা (Vajra bijaka), কণ্টফলা (Kanta phala) ও বিটপকরঞ্জ (Vitapakaranja), স্প্যানিশে মাতো-দ্য-প্লায়া (Mato de playa), তামিল ভাষায় কাঝারচিক্কাই (Kazharchikkaai), তেলেগুতে যক্ষাখি (Yakshakshi), উর্দুতে করঞ্জ (Karanja) বলা হয়।

ব্যবহার
-----------------------------
নাটা’র শেকড়, বীজ, পাতা ও বাকলে ঔষধি উপাদান আছে। আয়ুর্বেদমতে, ফলের খোসা পুড়িয়ে বা ভেজে গুঁড়ো করে কুইনাইনের বিকল্প হিশেবে ব্যবহার করা হয়। শেকড়ের রস গুঁড়োকৃমি, জ্বর, কাশি, ঋতুস্রাব ও সন্তান জন্মদানের পর জরায়ুর সমস্যা দূর করে। পাতার রস জলবসন্ত, যকৃতের রোগ ও ঘামের দুর্গন্ধ নাশে সহায়তা করে। নাটার বীজ দিয়ে তৈরি তরল পাকস্থলির সমস্যা নিরোধক এবং বাত নিরাময়কারী। প্রথাগত চিকিৎসামতে বীজের খোসা জ্বালা দমনকারী হিশেবেও ব্যবহৃত হয় (৬)। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিশুকিশোররা বিভিন্ন খেলায় এ বীজ গুঁটির মতো ব্যবহার করে। এছাড়া গবাদিপশুর হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য শস্যক্ষেত্রের আইলে এ গাছ লাগানো হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের অধিবাসীরা ম্যালেরিয়া ও কৃমি থেকে বাঁচার জন্য নাটাবীজের গুঁড়ো ব্যবহার করে। সোমোয়া ও টোঙ্গার আদিবাসীরা কাঁটাওয়ালা কাণ্ডের ফাঁদ পেতে বাদুড় দূর করে। গহনা তৈরিতেও নাটার বীজ ব্যবহার করা হয়।

সংরক্ষণের অবস্থা
-----------------------------
আইউসিএন-এর বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় (IUCN Red List) হরগজাকে ন্যুনতম বিপদাপন্ন (Least Concern) হিশেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে, এ প্রজাতিটি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ দেখা যায় নি।
Caesalpinia bonduc

পাদটীকা
-----------------------------
(১) বাদা সহযোগী : যেসব গাছ বাদাবনের যে কোনো একটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাধারণ পরিবেশে জন্মাতে পারে তাদেরকে ‘বাদা সহযোগী’ গাছ বলা হয়। বাদাবনের প্রধান চারটি বৈশিষ্ট্য হলো : জলাভূমি, লবণাক্ততা, তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও পলি অবক্ষেপণ।
(২) কালোবাদা : কতোটা লবণাক্ততায় বেড়ে উঠতে পারে সেই মাপকাঠি অনুসারে বাদাগাছগুলোকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা হয় : লালবাদা, কালোবাদা ও সাদাবাদা। মাঝারি মানের লবণাক্ততা (৫-১৮ পিপিটি) সহ্য করতে পারে এমন গাছগুলোকে কালোবাদা বলা হয়।
(৩) James Wallace (1883). A Description of the Isles of Orkney, 1693, 2nd ed. ed. John Small, Edinburgh
(৪) Jack D. Forbes (2007). The American Discovery of Europe. Urbana: University of Illinois.
(৫) পিপিটি : পার্টস্ পার থাউজ্যান্ড। প্রতি হাজারে ১ কণা থাকলে তাকে ১ পিপিটি বলা হয়। ১ লিটার পানিতে ১ মিলি লবণ থাকলে ওই পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ১ পিপিটি।
(৬) http://www.sciencepub.net/report/report0203/13_2487_komal_report0203_83_90.pdf
Caesalpinia bonduc

অধিকতর তথ্য
-----------------------------
(১) Khatun, B.M. Rizia (2009). Caesalpinia bonduc (L.) Roxb. (1832). In Ahmed, Z.U., Hassan, M.A., Begum, Z.N.T., Khondker, M., Kabir, S.M.H., Ahmad, M. and Ahmed, A.T.A (eds.). Encyclopedia of Flora and Fauna of Bangladesh, Vol. 9. Angiosperms: Dicotyledons (Balsaminaceae-Euphorbiaceae). Asiatic Society of Bangladesh. Dhaka.
(২) পাল, নিশীথ কুমার (২০১৫). উদ্ভিদবিজ্ঞান শব্দকোষ. অন্বেষা প্রকাশন. ঢাকা
(৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Caesalpinia_bonduc
(৪) https://en.wikipedia.org/wiki/Nickernut
(৫) http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3459446/
(৬) http://www.alwaysayurveda.com/caesalpinia-bonducella/
(৭) http://eol.org/pages/703525/overview
(৮) http://indiabiodiversity.org/species/show/32057
(৯) http://waynesword.palomar.edu/nicker.htm
(১০) http://lkcnhm.nus.edu.sg/dna/organisms/details/482
প্রদায়ক
-----------------------------
হাসান মেহেদী (mehedi.coastline@gmail.com)