Tuesday 12 April 2016

Ceriops decandra (ঝামটি গরান)

Ceriops decandra
ঝামটি গরানের বৈজ্ঞানিক নাম Ceriops decandra। গ্রীক শব্দ Decandra’র অর্থ ‘দশজন পুরুষ’। এটিকে বাংলায় জাইলা গরান, গুট্টিয়া বা গুটাইয়াও বলা হয়। ঝামটি গরানের ফুলে ১০ থেকে ১২টি পুংকেশর থাকে বলেই হয়তো দ্বিপদী নামে Decandra শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে [১]। বাদাগাছের যতোগুলো মূখ্য প্রজাতি আছে গরান তার মধ্যে অন্যতম। এ গাছের ফুল থেকে অনেক মধু পাওয়া যায়। গন্ধ ও স্বাদের কারণে গরান ও খলসি (Aegiceras corniculatum) ফুলের মধুর সুখ্যাতি আছে।

ঝামটি গরান একটি ছোট গাছ বা গুল্ম। কয়েকটি গরান গাছ গাদাগাদি করে জন্মায় বলে বনজীবীরা ‘গরানের ঝাড়’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। একহারা লম্বা ঝামটি গরানের কাণ্ড উপকূলীয় এলাকায় ঘরের বারান্দার খুঁটি, চালের কাঠামো বা জ্বালানি কাঠের কাজে ব্যবহার করে থাকেন [২]

Ceriops decandra
বিবরণ
ঝামটি গরান একটি চিরসবুজ, মাঝারি আকৃতির, সরু, সোজা, ধীর বর্ধনশীল ও বহুবর্ষজীবী গুল্ম যা মাত্র ১.৫ থেকে ৪ মিটার লম্বা হয়। গাছের চারদিক ছড়িয়ে সরু ডালপালা হয়। কাণ্ডটাও সরু। সরু হলে কী হবে, ঝামটি গরান গাছের কাণ্ড কিন্তু খুবই শক্ত এবং নোনাপানিতে টিকে থাকার জন্য প্রচুর কার্বন ধরে রাখে। এ কারণে এ গাছের কাঠ বহু বছর নষ্ট হয় না। কাদা ও নোনাপানির মধ্যে বেড়ে উঠতে হয় বলে ঝামটি গরান গাছের চারপাশে অসংখ্য ঠেসমূল (stilt-root) থাকে। ঠেসমূলগুলোর গায়ে আবার বাতাস নেয়ার জন্য থাকে বায়ুমূল। মূল মাটির গভীরে প্রবেশ করে না। ঠেসমূলগুলো এমনভাবে থাকে যেন মনে হয়, ঠেসমূল একত্রিত হয়েই গাছটার জন্ম হয়েছে।

ঝামটি গরানের পাতা ৫-১০ সেমি লম্বা ও ২-৫ সেমি চওড়া। দেখতে অনেকটা ডিম্বাকার। পাতার গোড়ার দিকটা সরু এবং অগ্রভাগ গোলাকার তবে অগ্রভাগে খাঁজ আছে। অন্যান্য লাল ও কালোবাদা গাছের মতো ঝামটি গরানের পাতাও একটু পুরু কারণ লবণ-সহনশীল এসব গাছের প্রস্বেদনে প্রচুর শক্তিব্যয় করতে হয়। প্রস্বেদনের মাধ্যমে এ গাছ নিজের শরীর থেকে লবণ ছেঁকে ফেলে দেয়। সে কারণে ঝামটি গরানের পাতার তলদেশে শাদা রঙের লবণ দেখতে পাওয়া যায়। ঝামটি গরানের ফুল ছোট ও সুগন্ধময়। ফুলগুলো ০.৫ সেমি’র চেয়ে বড় হয় না [৩]। ফুল উভয়লিঙ্গ অর্থাৎ স্বপরাগায়নে সক্ষম। ফুল থেকে বাদামি রঙের ১.৫-২.০ সেমি মোচাকৃতির ফল হয়। ফলে একটিই মাত্র বীজ থাকে। এ গাছের ফুল থেকে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম হয় অর্থাৎ ফুল থেকে যে ফল হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই অঙ্কুরোদ্গম ঘটে যা জরায়ুজ অঙ্কুর (Propagule) নামে পরিচিত।

অনেক সময় অঙ্কুরটি গাছে থাকতেই শেকড় জন্মায়। ১০-১২ সেমি লম্বা অঙ্কুরটি মাঝখানে একটু মোটা হলেও প্রান্তভাগ সরু। এর ফলে গাছ থেকে অঙ্কুরটি খাড়া হয়ে মাটিতে পড়ে। এ গাছটি জন্মানোর স্থান যেহেতু কাদাময়, সেহেতু অঙ্কুরগুলো সোজা মাটিতে ঢুকে যায় এবং পলিবাহিত ঊর্বর মাটিতে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। এছাড়া এ অঙ্কুরগুলো খুবই হালকা। জোয়ার-ভাটার পানিতে পড়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় আরেক চর বা দ্বীপে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই সেখানে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় [৪]

বর্গ : Malpighiales, পরিবার : Rhizophoraceae, গণ : Ceriops, প্রজাতি : C. decandra
দ্বিপদী নাম : Ceriops decandra (Griff.) Ding Hou
সমনাম : Bruguiera decandra Griff., Ceriops candolleana Náves, Ceriops roxburghiana Arn.
উদ্ভিদের ধরন : চিরসবুজ গুল্ম (Evergreen Shrub)
আবাসস্থল : লবণাক্ত উপকূলের তুলনামূলকভাবে উঁচু ও অনিয়মিত প্লাবিত এলাকা
বাদাগাছের ধরন : মূখ্যবাদা, কালোবাদা
পাতার ধরন : সরল, প্রতিমুখ ও ডিম্বাকার, ৫-১০ সেমি লম্বা
ফুলের ধরন : ৫-৬টি পাপড়ি ও বৃত্যাংশ, ০.৫ সেমি দীর্ঘ
ফুল ও ফলের সময় : মার্চ থেকে মে পর‌্যন্ত ফূল ফোটে এবং এপ্রিল থেকে জুলাই পর‌্যন্ত ফল পাওয়া যায়
সংরক্ষণ পরিস্থিতি : প্রায় বিপদাপন্ন

আবাসস্থল
ঝামটি গরান পরিমিত থেকে উচ্চ লবণাক্ততা পর‌্যন্ত সব পর‌্যায়ের লবণাক্ততায় জন্মাতে ও বেড়ে উঠতে পারে। এ প্রজাতির গাছ অল্প জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে বলে সাধারণত তুলনামূলকভাবে উঁচু ভূমিতে জন্মায়। এ গাছের বসতি সুন্দরী গাছের বসতি এলাকার মতো পুরোপুরি শুকনো নয়, বরং ভেজা ও কাদায় ভরা। সাধারণত হরগজা (Acanthus ilicifolius), গেওয়া (Excoecaria agallocha), সুন্দরী (Heritiera fomes), গুরা বা রোহিণী (Kandelia candel) ও কেওড়া (Sonneratia apetala) গাছের সাথে বসতি ভাগাভাগি করে ঝামটি গরান গাছ জন্মায়

পরিব্যাপ্তি
অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ব্রুনেই দারুসসালাম, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মায়ানমার (বার্মা), সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বাদাবন এলাকায় ঝামটি গরান গাছ পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীতে গরান-আবৃত এলাকার আয়তন প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বর্গ কিমি। সুন্দরবন ছাড়াও বাংলাদেশের বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের উপকূলীয় এলাকায় এ গাছ পাওয়া যায় [৫]
Ceriops decandra


বৈজ্ঞানিক নাম ও সমনাম
ঝামটি গরানের বৈজ্ঞানিক নাম Ceriops decandra প্রথম চিহ্নিত করেন ব্রিটিশ ডাক্তার, নিসর্গী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম গ্রিফিথ (William Griffith) যাঁকে সংক্ষেপে Griff. নামে ডাকা হয়। গ্রিফিথের উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সূত্র ধরে ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভূত ওলন্দাজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী Ding Hou (1921-2008) এ নামকরণ করেন। Ceriops decandra-এর পুরো নাম হবে Ceriops decandra (Griff.) Ding Hou। এর অন্যান্য সমনামের মধ্যে রয়েছে: Bruguiera decandra Griff., Ceriops candolleana Náves ও Ceriops roxburghiana Arn. গরানের ৪টি প্রজাতি সারা পৃথিবীতে পাওয়া যায়। সেগুলো হলো : Ceriops australis, Ceriops decandra, Ceriops tagalCeriops zippeliana। এর মধ্যে বাংলাদেশে শুধুমাত্র Ceriops decandraCeriops tagal পাওয়া যায়। Ceriops tagal স্থানীয় জনসাধারণের কাছে মটগরান নামে পরিচিত।

স্থানীয় নাম
বাংলাদেশে ও ভারতে বাংলায় Ceriops decandra গরান, ঝামটি গরান বা জাইলা গরান নামেই পরিচিত। এছাড়া গুট্টিয়া বা গুটাইয়াও বলা হয়। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় Flat-Leaf Spurred Mangrove, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে টেঙ্গার (Tengar), কম্বোডিয়ায় স্মায়ে (Smae), ইংরেজিতে Spur Mangrove, Indian Mangrove বা Tagal Mangrove, ইন্দোনেশিয়ায় টেঙ্গার, পালুন বা বিডো-বিডো (Tengar, Palun or Bido-Bido), ফিলিপাইনে বারাস-বারাস (Baras-Baras) ও মালাটাঙ্গাল (Malatangal), মায়ানমারে (বার্মা) কা পেয়েং (Ka-Pyaing), ওড়িয়া ভাষায় গরানি বা গরলাহ (Garani or Garlah), সিংহলিজ (শ্রীলঙ্কা) ভাষায় কাদোল (Kadol), তামিল ভাষায় চিরু কান্দাল (Chiru Kandal), তেলেগুতে গাথারু (Gatharu), থাইল্যান্ডে কাপুলং, প্রংখাও বা সামায় মানোহ (Kapuulong, Prong Khaao or Samae Manoh) এবং ভিয়েতনামে জ্বা বা মাইরসর (Dza or Smairsor) বলা হয় [৬]

ব্যবহার
ঝামটি গরানের কাণ্ড সরু হলেও মজবুত। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় এলাকায় সাধারণ বাড়িঘরে বারান্দার খুঁটির জন্য এ গাছের কাণ্ড ব্যবহারের প্রচলন আছে। বর্ষা-কাদায় নষ্ট হয় না বলে এ গাছের কাণ্ড দিয়ে ঘরের চালের কাঠামো খুবই ভালো হয়। ছোট নৌকার কাঠামো (পাঁজরা) তৈরিতেও ঝামটি গরানের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কাঠি, লাঠি, ও জ্বালানি হিশেবেও এ গাছ ও ডালপালার ব্যবহার আছে। গরানের কাঠ পুড়িয়ে ভালো মানের কয়লা তৈরি হয়। জেলেরা খাল বা চরের চারদিকে জালের ঘেরা দেয়ার জন্য এ গাছের কাণ্ড ব্যবহার করে বলে নাম হয়েছে জালিয়া গরান।

দুই ধরনের গরানের মধুই সুগন্ধী, অত্যন্ত সুস্বাদু ও ভেষজ গুণসম্পন্ন। এজন্য বনজ মধুর মধ্যে গরানের মধুর চাহিদা ব্যাপক। ঝামটি গরানের বাকল ট্যানিনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। মাছ ধরার জাল পাকা করতে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। উপকূলীয় জেলেরা গরানের ছাল (বাকল) পানির জালার মধ্যে ভিজিয়ে বাকলের কষ বের করতো। তারপর কষ জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো জালের সুতো শক্ত করার উপকরণ। গরানের বাকলের রস থেকে কালো রঙ উৎপন্ন হয় যা পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত [৭]

প্রাচীনকাল থেকেই প্রথাগত চিকিৎসায় ঝামটি গরানের ব্যবহার আছে। বাকলের রস রক্ত পড়া বন্ধ করে। বাকলের রসের ক্বাথ রক্তস্রাব চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। চর্মরোগ, কুষ্ঠ ও ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় পাতার ব্যবহার আছে।

সংরক্ষণ পরিস্থিতি
আইইউসিএন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় (IUCN Red List) ঝামটি গরান ‘প্রায় বিপদাপন্ন’ (Near Threatened) হিশেবে চিহ্নিত। পুরোপুরি সঠিক হার না জানা গেলেও ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল - এই ২০ বছরে ঝামটি গরান-আবৃত বাদাবনের পরিমান ১২-২০ শতাংশ কমে গেছে। তিন প্রজন্মের (১২০ বছর) সঠিক উপাত্ত পাওয়া গেলে নিশ্চিতভাবেই এ প্রজাতিটি ‘বিপদাপন্ন’ তালিকার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে [৮]। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই ঝামটি গরান সংরক্ষণে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেই। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে বনজ সম্পদ হিশেবে অন্যান্য গাছের সঙ্গে গরান গাছের সংগ্রহ ও ব্যবহারের অনুমোদন প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্ববসতিতে রক্ষা করার জন্য আরো কার‌্যকর কর্মসূচি নেয়া দরকার।

অধিকতর পাঠ
Ceriops australis, Ceriops zippeliana, উইলিয়াম গ্রিফিথ (William Griffith), উচ্চ লবণাক্ততা (Hyper Salinity), উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জরায়ুজ অঙ্কুর (Propagule), ঠেসমূল (stilt-root), ডিং হৌ (Ding Hou), মটগরান (Ceriops tagal)


সংশ্লিষ্ট উপকরণ
- Customary Use of Mangrove Tree as a Folk Medicine among the Sundarbans Resource Collectors
- Global Forest Resources Assessment 2010: Country Reports - Bangladesh
- Medicinal and Aromatic Plants as Global Resources
- The Undergrowth Species of Sundarban Mangrove Ecosystem (Bangladesh)
- World Atlas of Mangroves 2010

তথ্যসূত্র 
(১) https://en.wikipedia.org/wiki/Ceriops_decandra
(২) হোসেন, মাহমুদ (২০১৫). সুন্দরবন বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বৃক্ষ পরিচিতি. জিআইজেড. ঢাকা : সেপ্টেম্বর ২০১৫. পৃ. ৩৬
(৩) http://eol.org/pages/3062587/overview
(৪) http://ecocrop.fao.org/ecocrop/srv/en/cropView?id=4434
(৫) http://amap-collaboratif.cirad.fr/pages_logiciels/Mangrove_web/especes/c/cerde/cerde.html
(৬) Ceriops decandra (Griff.) Ding Hou: http://globinmed.com/index.php?option=com_content&view=article&id=79163:ceriops-decandra-griffith-ding-hou&catid=367:c
(৭) রহমান, এম অলিউর (২০০৯). Ceriops decandra. In Ahmed, Z.U., Hassan, M.A., Begum, Z.N.T., Khondker, M., Kabir, S.M.H., Ahmad, M. and Ahmed, A.T.A (eds.). Encyclopedia of Flora and Fauna of Bangladesh, Vol. 10. Angiosperms: Dicotyledons (Balsaminaceae-Euphorbiaceae). Asiatic Society of Bangladesh. Dhaka. pp. 20-21
(৮) http://www.iucnredlist.org/details/178853/0


প্রদায়ক

Hasan Mehedi, Taposh BaruaKhasru Chowdhury

Saturday 9 April 2016

Caesalpinia bonduc (নাটা)

Caesalpinia bonduc
নাটা (Caesalpinia bonduc) গাছটিকে ইংরেজিতে গ্রে নিকার (Gray Nicker) বলে ডাকা হয়। সম্ভবত ওলন্দাজ শব্দ নিক্কার (knikker) থেকে ক্যারিবীয় nicker শব্দটা এসেছে যার অর্থ ‘কাদার গুঁটি’। ক্যারিবীয় অঞ্চলে ষোলগুঁটি বা আটগুঁটি খেলার মতো ওয়ারে (oware) নামক একটি পারিবারিক খেলায় গুঁটি হিশেবে নাটার বীজ ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হয়, এ কারণেই নাটার নাম ইংরেজিতে গ্রে নিকার হয়েছে। এটা একটা বাদা সহযোগী বা Mangrove Associate গাছ (১)। অর্থাৎ এই প্রজাতিটি বাদাবনের বাইরে মাঝারি লবণাক্ত পরিবেশে জন্মাতে পারে। মাঝারি মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে বলে এ গাছটিকে ‘কালোবাদা’ বা Black Mangrove-এর অন্তর্ভূক্ত করা হয় (২)। নাটা প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের উপকূল ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে জন্মায়। তবে, বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই নাটাগাছ দেখা যায়। এই গণের আরেকটি গাছ কুটুমকাঁটা বা Caesalpinia cristaও বাদাবনে (Mangrove Forest) পাওয়া যায়।

বিবরণ
-----------------------------
নাটাগাছ একটি বিশৃঙ্খলভাবে বাড়ন্ত গুল্ম বা ঝোপজাতীয় গাছ হলেও কখনও কখনও অন্য গাছের উপর ভর করেও বেড়ে ওঠে। ৫-৬ মিটার উচ্চতার গাছটির ৩০-৫০ সেমি লম্বা শাখায় যৌগিক পাতা হয়। প্রত্যেক একজোড়া পাতার গোড়ায় দুটি করে কাঁটা থাকে। কাঁটাগুলো পেছনমূখী হওয়ায় কোনো প্রাণীর গায়ে লাগলে সহজে ছাড়িয়ে আসতে পারে না। এভাবেই নাটাগাছ নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করে। ৬-৭ সেমি লম্বা ও ৩-৪ সেমি চওড়া চ্যাপ্টা ডিম্বাকৃতির ও হালকা সবুজ রঙের ফল হয়। ফলের গায়ে বড়শির মতো অসংখ্য কাঁটা থাকে। নাটার ফল পাকার পর শুকিয়ে ফেটে যায়। হঠাৎ করে এতো জোরে ফাটে যে বীজ গাছ থেকে অন্তত ২ মিটার দূরে গিয়ে পড়ে। এভাবে নাটাগাছ শুধু বংশবিস্তারই করে না, বরং নতুন নতুন এলাকা দখল করে নেয়। নাটার বীজ শালিকের ডিমের চেয়ে কিছুটা ছোট এবং ধূসর রঙের হয়। বংশবিস্তারে এদের দুটো বিরাট সুবিধা আছে, যা অন্যান্য গাছের নেই। প্রথমত, এদের বীজ ধূসর রঙের হওয়ায় সহজে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। ফলে বীজভূক পশুপাখি সহজে নাটার বীজ খুঁজে পায় না। আর দ্বিতীয়ত বীজ অত্যন্ত হালকা বিধায় জোয়ারভাটার স্রোতের সঙ্গে বহুদূর ভেসে যেতে পারে। ১৬৯৩ সালে স্কটল্যান্ডের মন্ত্রী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জেমস ওয়ালেস উল্লেখ করেন যে, সামুদ্রিক ঝড় ও স্রোতের সঙ্গে নাটার বীজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের উপকূলে চলে আসে (৩)। ১৭৫১ সালে ডেনমার্কের ইতিহাসবিদ এরিক পন্টোপিড্যানও নরওয়ের উপকূলে এ বীজ ভেসে আসার ঘটনা উল্লেখ করেছেন (৪)।
বর্গ : Fabales; পরিবার : Caesalpiniaceae; গণ : Caesalpinia; প্রজাতি : bonduc
উদ্ভিদের ধরন : গুল্ম বা ঝোপ
বসতি এলাকা : উপকূল বা উপকূলবর্তী ছোট ঝোপবিশিষ্ট জঙ্গল
বাদাগাছের ধরন : বাদা সহযোগী, কালোবাদা।
পাতার ধরন : যৌগিক পাতা, একসঙ্গে ৭-১২ জোড়া পাতা হয়। পাতা ২-৪ সেমি লম্বা, দীর্ঘ ডিম্বাকার। উপপত্র আছে।
ফুলের ধরন : হলদে ফুল হয়। পাঁচটি বৃত্যাংশ বা পাপড়ি থাকে।
ফুল ও ফল ধারণ : জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ফুল হয় এবং অক্টোবর থেকে জানুয়ারির মধ্যে ফল পেকে যায়।
আবাসস্থল
-----------------------------
উপকূলবর্তী মাঝারি মাত্রার (৫-১৮ পিপিটি) লবণাক্ত পরিবেশে নাটাগাছ জন্মাতে পারে (৫)। এরকম লবণাক্ত পরিবেশকে Mesohaline Zone বলা হয়। সামান্য লবণাক্ত বা লবণাক্ত নয় এমন সাধারণ পরিবেশেও এ গাছ জন্মায়। অনূর্বর বা সামান্য ঊর্বর জমিতেও নাটাগাছ বেড়ে উঠতে পারে। শস্যক্ষেত্রের সীমানা, পথের ধার এবং কখনও কখনও খালি জায়গায় ঘন ঝোপ আকারেও জন্মায়। বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই নাটাগাছ দেখা যায়।

পরিব্যাপ্তি
-----------------------------
পুরো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা জুড়ে নাটাগাছ ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, বার্মা (মিয়ানমার), চীন, কলাম্বিয়া, কমোরোস, কোস্টারিকা, কিউবা, ইথিওপিয়া, ইকুয়েডর, গ্যাবন, গিনি, ঘানা, ভারত, জ্যামাইকা, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নেপাল, নিকারাগুয়া, নাইজেরিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, পেরু, পুয়ের্তে রিকো, সিয়েরা লিওন, সিঙ্গাপুর, সোমোয়া, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, তানজানিয়া, টোঙ্গা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামে নাটাগাছ পাওয়া যায়।

বৈজ্ঞানিক নাম ও সমনাম
Caesalpinia bonduc
-----------------------------
নাটা’র বৈজ্ঞানিক নাম Caesalpinia bonduc, নামকরণ করেছেন William Roxburgh যাঁকে সংক্ষেপে Roxb. বলা হয়। তিনি Carl Linnaeus-এর প্রাথমিক শনাক্তিকরণ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে ১৮৩২ সালে এ গাছের নামকরণ করেন। নাটার বৈজ্ঞানিক নামের পূর্ণরূপ : Caesalpinia bonduc (L.) Roxb. (1832)। অন্যান্য নামগুলো হলো Bonduc minus Medik., Caesalpinia bonducella (L.) Fleming, Caesalpinia crista L., p.p.a, Caesalpinia cristata Prowazek, Guilandinia bonduc L. ও Guilandinia bonducella L.।

স্থানীয় নাম
-----------------------------
বাংলায় নাটা’র আরো কয়েকটি নাম প্রচলিত আছে। যেমন : কাঁটানাটা, নাটাকরঞ্জ, ঝাগরাগোটা বা লালকান্তা। নাটা গাছটিকে আরবিতে আকিত-মাকিত (akit-makit), অসমীয়তে লেটাগুঁটি (Letaguti), ক্যারিবীয় অঞ্চলে গ্রে নিকার (Gray Nicker), ইংরেজিতে Gray Nicker, Nicker Nut, Indian Nut, Benzoar Nut, Nickar Bean বা Physic Nut, ফারসিতে খায়াহে-ই-ইবলিস (khayahe-i-iblis), জার্মান ভাষায় কুগেলস্ট্রস (Kugelstrauch), হিন্দিতে কাঠকরঞ্জ (Kat Karanj), ইন্দোনেশিয়ায় আরেউজ (Areuj), আরুক (Aruk), বাগোরে (Bagoré), কানিকের (Kaniker) ও কুটুক (Kutuk), কানাড়ায়, গেজ্জুগা (Gejjuga), মালায়ালামে কাঝানচিক্কুরু (Kazhanchikkuru), মারাঠিতে সাগরগোটি (Sagargoti), উড়িয়ায় গিলো (Gilo), পর্তুগীজে নজ-ডি-বোনডাক (noz de bonduque), সংস্কৃতে দুস্পর্শ (Duhsparsa), কণ্টকি করঞ্জা (Kantaki karanja), বজ্র বীজাকা (Vajra bijaka), কণ্টফলা (Kanta phala) ও বিটপকরঞ্জ (Vitapakaranja), স্প্যানিশে মাতো-দ্য-প্লায়া (Mato de playa), তামিল ভাষায় কাঝারচিক্কাই (Kazharchikkaai), তেলেগুতে যক্ষাখি (Yakshakshi), উর্দুতে করঞ্জ (Karanja) বলা হয়।

ব্যবহার
-----------------------------
নাটা’র শেকড়, বীজ, পাতা ও বাকলে ঔষধি উপাদান আছে। আয়ুর্বেদমতে, ফলের খোসা পুড়িয়ে বা ভেজে গুঁড়ো করে কুইনাইনের বিকল্প হিশেবে ব্যবহার করা হয়। শেকড়ের রস গুঁড়োকৃমি, জ্বর, কাশি, ঋতুস্রাব ও সন্তান জন্মদানের পর জরায়ুর সমস্যা দূর করে। পাতার রস জলবসন্ত, যকৃতের রোগ ও ঘামের দুর্গন্ধ নাশে সহায়তা করে। নাটার বীজ দিয়ে তৈরি তরল পাকস্থলির সমস্যা নিরোধক এবং বাত নিরাময়কারী। প্রথাগত চিকিৎসামতে বীজের খোসা জ্বালা দমনকারী হিশেবেও ব্যবহৃত হয় (৬)। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিশুকিশোররা বিভিন্ন খেলায় এ বীজ গুঁটির মতো ব্যবহার করে। এছাড়া গবাদিপশুর হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য শস্যক্ষেত্রের আইলে এ গাছ লাগানো হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের অধিবাসীরা ম্যালেরিয়া ও কৃমি থেকে বাঁচার জন্য নাটাবীজের গুঁড়ো ব্যবহার করে। সোমোয়া ও টোঙ্গার আদিবাসীরা কাঁটাওয়ালা কাণ্ডের ফাঁদ পেতে বাদুড় দূর করে। গহনা তৈরিতেও নাটার বীজ ব্যবহার করা হয়।

সংরক্ষণের অবস্থা
-----------------------------
আইউসিএন-এর বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় (IUCN Red List) হরগজাকে ন্যুনতম বিপদাপন্ন (Least Concern) হিশেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে, এ প্রজাতিটি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ দেখা যায় নি।
Caesalpinia bonduc

পাদটীকা
-----------------------------
(১) বাদা সহযোগী : যেসব গাছ বাদাবনের যে কোনো একটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাধারণ পরিবেশে জন্মাতে পারে তাদেরকে ‘বাদা সহযোগী’ গাছ বলা হয়। বাদাবনের প্রধান চারটি বৈশিষ্ট্য হলো : জলাভূমি, লবণাক্ততা, তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও পলি অবক্ষেপণ।
(২) কালোবাদা : কতোটা লবণাক্ততায় বেড়ে উঠতে পারে সেই মাপকাঠি অনুসারে বাদাগাছগুলোকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা হয় : লালবাদা, কালোবাদা ও সাদাবাদা। মাঝারি মানের লবণাক্ততা (৫-১৮ পিপিটি) সহ্য করতে পারে এমন গাছগুলোকে কালোবাদা বলা হয়।
(৩) James Wallace (1883). A Description of the Isles of Orkney, 1693, 2nd ed. ed. John Small, Edinburgh
(৪) Jack D. Forbes (2007). The American Discovery of Europe. Urbana: University of Illinois.
(৫) পিপিটি : পার্টস্ পার থাউজ্যান্ড। প্রতি হাজারে ১ কণা থাকলে তাকে ১ পিপিটি বলা হয়। ১ লিটার পানিতে ১ মিলি লবণ থাকলে ওই পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ১ পিপিটি।
(৬) http://www.sciencepub.net/report/report0203/13_2487_komal_report0203_83_90.pdf
Caesalpinia bonduc

অধিকতর তথ্য
-----------------------------
(১) Khatun, B.M. Rizia (2009). Caesalpinia bonduc (L.) Roxb. (1832). In Ahmed, Z.U., Hassan, M.A., Begum, Z.N.T., Khondker, M., Kabir, S.M.H., Ahmad, M. and Ahmed, A.T.A (eds.). Encyclopedia of Flora and Fauna of Bangladesh, Vol. 9. Angiosperms: Dicotyledons (Balsaminaceae-Euphorbiaceae). Asiatic Society of Bangladesh. Dhaka.
(২) পাল, নিশীথ কুমার (২০১৫). উদ্ভিদবিজ্ঞান শব্দকোষ. অন্বেষা প্রকাশন. ঢাকা
(৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Caesalpinia_bonduc
(৪) https://en.wikipedia.org/wiki/Nickernut
(৫) http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3459446/
(৬) http://www.alwaysayurveda.com/caesalpinia-bonducella/
(৭) http://eol.org/pages/703525/overview
(৮) http://indiabiodiversity.org/species/show/32057
(৯) http://waynesword.palomar.edu/nicker.htm
(১০) http://lkcnhm.nus.edu.sg/dna/organisms/details/482
প্রদায়ক
-----------------------------
হাসান মেহেদী (mehedi.coastline@gmail.com)

Acanthus volubilis (হরগজা লতা)

হরগজা লতা বাদাবনের ঝোপ ধরনের গাছ বা গুল্ম। বসতি ও বেড়ে ওঠার প্রকৃতি বিবেচনায় একে লালবাদার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। হরগজা লতার কাণ্ড হরগজার চেয়েও অশক্ত। তাই এ গাছ লতিয়ে বা চারপাশে ছড়িয়ে বেড়ে ওঠে।

বিবরণ
------------------------------------
হরগজা লতার কাণ্ড ৪ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা জলাভূমির পাড় বা অন্য গাছের গায়ে বেয়ে উঠতে পছন্দ করে। নিরিবিলি পরিবেশ পেলে এরা বেয়ে বেয়ে গাছের মাথায়ও উঠে যায়। যেখানেই জন্মাক না কেন, হরগজা লতা চারপাশে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে নিজের বসতির এলাকা বাড়িয়ে নেয়। গাছটি গুচ্ছমূল দিয়ে মাটি ধরে রাখে; কখনও কখনও ঠেসমূলও দেখা যায়।

হরগজা লতার পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, পাতায় কোনো কাঁটা নেই। পাতা দেখতে ডিম্বাকার বা চোখের মতো। পাতার উপরে ও নীচে মোমের মতো আস্তরণ আছে। শাখা থেকে বেরোনো ১০-১২ সেমি লম্বা শীষের মাথায় পাঁচ পাপড়ির ফুল হয়। নীলাভ সাদা রঙের ফুলগুলো বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে থাকে। ফুল থেকে হরগজার মতোই ক্যাপসুল আকৃতির ফল হয়।

ফল হলে কী হবে, হরগজা লতা বংশবৃদ্ধির জন্য মোটেই শুধুমাত্র ফলের উপর নির্ভরশীল না। গাছের গোড়ার দিকে যে শাখাগুলো বেরোয় সেগুলো একটু ঊর্বর মাটি পেলেই শেকড় গজিয়ে নিজেরা এক একটা গাছে পরিণত হয়। আবার, শুকনো ফল ফেটে বীজ ছড়িয়ে পড়ে দুই থেকে আড়াই মিটার দূরে। সেখানেও নতুন চারা গজায়। হরগজা লতা বিপুল হারে বাড়তে পারে এবং অন্য গুল্মের এলাকা দখল করে নেয়।

আবাসস্থল
------------------------------------
হরগজা লতা সাধারণত কাদাময় স্থানে ঘাস ও অন্যান্য গুল্মের সঙ্গে জন্মায়। সাধারণত উপকূলীয় ডোবা, জলাভূমি ও খালের পাড়ে এ হরগজা লতা পাওয়া যায়।

পরিব্যাপ্তি
------------------------------------
বাংলাদেশ, ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, চীন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার (বার্মা), পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে হরগজা লতা পাওয়া যায়। হরগজার একই গণ-এর আর দুটি প্রজাতি হলো হরগজা (Acanthus ilicifolius) ও Acanthus ebracteatus। হরগজা লতার মতোই Acanthus ebracteatus -এর ফুলের রঙ শাদা। আর হরগজার কথা তো আগেই বলা হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক নাম ও সমনাম
------------------------------------
হরগজা লতার বৈজ্ঞানিক নাম Acanthus volubilis। এর নামকরণ করেছেন নাথানিয়েল ওয়ালিস (Nathaniel Wallich) যাঁকে সংক্ষেপে ওয়াল. (Wall.) নামে অভিহিত করা হয়। অন্যান্য নামগুলো হলো : Dilivaria scandens Nees ও Dilivaria volubilis (Wall.) Nees

স্থানীয় নাম
------------------------------------
ইংরেজিতে হরগজা লতাকেও Sea Holly বা Holly Mangrove বলা হয়। ভারতীয় বাংলায় লতা হরগজা, চীনে লাও শু লে (Lao shu le), ফিলিপাইনে ডাগুরাই (Dagurai), জার্মান ভাষায় স্টেচপমেনব্লাট্রিগ বারেনক্লাউ (Stechpalmenblättrige Bärenklau), জাপানে আকানসাসু ইরিকিফোরিয়াসু (Akansasu irikiforiusu), মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে জেরুজু (Jeruju), মিয়ানমার (বার্মা)য় খা-ইয়ার-নুয়ি (Kha-yar-nwe), উড়িয়া ভাষায় হরকঞ্চা (Harakancha), তুরস্কে কোবানপুস্কুলু ইয়াপ্রাকি আয়ি পেনসেসি (Çobanpüskülü yaprakli ayi pençesi) এবং ভিয়েতনামে ও রো (O Ro) বলা হয়।

ব্যবহার
------------------------------------
প্রাচীনকাল থেকে আলসার, কালাজ্বর ও কাশির চিকিৎসায় হরগজা লতা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া চুলপড়া বন্ধ করতে, বাঘ বা সাপের কামড়ের পর বিষক্রিয়া কমাতে, কৃমির চিকিৎসায় এবং রক্ত পরিস্কার করায় হরগজা লতার পাতা ও বীজ ব্যবহারের নজির আছে।

সংরক্ষণ পরিস্থিতি
------------------------------------
আইউসিএন-এর বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় (IUCN Red List) হরগজাকে ন্যুনতম বিপদাপন্ন (Least Concern) হিশেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও জাতিসঙ্ঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন (২০০৫) অনুসারে বলেছে ১৯৮৭ সালের পরবর্তী ২৫ বছরে হরগজা লতার ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পৃথিবীব্যাপী বাদাবনের আয়তন ও ঘনত্ব কমে যাবার কারণে হরগজার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
Acanthus volubilis
Acanthus volubilis

প্রদায়ক
------------------------------------
হাসান মেহেদী (mehedi.coastline@gmail.com)

Acanthus illcifolius (হরগজা)

Acanthus illcifolius
হরগজা বাদাবনের ঝোপ ধরনের গাছ বা গুল্ম। বাংলায় একে হরকুচ, কটকি বা টেংরাকাঁটাও বলা হয়। এটি একটি গৌণ বাদাগাছ; অর্থাৎ এই পরিবারের অন্যান্য প্রজাতি সাধারণ পরিবেশেও বেড়ে উঠতে পারে। বেড়ে ওঠার পরিবেশ বিবেচনায় একে লালবাদার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। লালবাদা মানে হলো উদ্ভিদ-প্রজাতিটি অতিরিক্ত লবণাক্ততায় বেড়ে উঠতে ও টিকে থাকতে পারে। এর কাণ্ড অশক্ত। তাই এ গাছ কিছুটা খাড়া হয়ে, লতিয়ে বা চারপাশে ছড়িয়ে বেড়ে উঠতে পারে। সাধারণত উপকূলীয় হ্রদ, ডোবা, জলাভূমি ও সমুদ্র সৈকতে এ গাছগুলো জন্মায়।

বিবরণ
------------------------------------
হরগজার কাণ্ড ১ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। শাখা থেকে বেরোনো ছোট্ট শীষের মাথায় ফুল ফোটে। ফুলের রঙ নীল ও পাতা গাঢ় সবুজ। এদের পাতা খুব শক্ত (১)। হরগজা ফুলে প্রচুর উৎকৃষ্ট মানের মধু হয়! নিজেকে রক্ষা করার জন্য গাছগুলোর পাতার গোড়ায় ও অগ্রভাগে কাঁটা থাকে। হরগজার ফুল থেকে ক্যাপসুলের মতো ফল হয়। প্রত্যেকটি ফলে চারটি করে বীজ থাকে (২)। ফলের বীজগুলো চ্যাপ্টা ও শাদাটে। ফল পাকার পর শুকিয়ে গেলে শব্দ করে ফেটে যায়। এতে ফলের বীজ ছুটে প্রায় ২ মিটার দূরে গিয়ে পড়ে। এভাবে হরগজা বংশবৃদ্ধির পাশাপাশি বসতির এলাকা বাড়ায়।

বাংলাদেশে হরগজার দুটো প্রজাতি পাওয়া যায়। আরেকটি প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Acanthus volubilis । বাংলায় বলা হয় হরগজা লতা। এ প্রজাতিটির ফুল নীলাভ হলেও পাতার গায়ে কোনো কাঁটা নেই। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের বাদাবনে ৩টি প্রজাতি পাওয়া যায়। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় পাওয়া যায় আরো একটি প্রজাতি। অন্যান্য দেশের আলাদা প্রজাতি দুটোর বৈজ্ঞানিক নাম Acanthus ebracteatusAcanthus xiamenensis। হরগজার ফুল নীলাভ হলেও এ দুটো প্রজাতির ফুল শাদা।

আবাসস্থল
------------------------------------
এ গাছটি বাদাবনের নদী বা খালের পাড়ে এবং ডোবা ও জলাভূমিতে জন্মায়। ঈষৎ লবণাক্ত থেকে তীব্র লবণাক্ততায়ও এ গাছটি জন্মাতে ও বেড়ে উঠতে পারে (৩)।

পরিব্যাপ্তি
------------------------------------
অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ম্যাকাও, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার (বার্মা), পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, পূর্ব তিমুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এ গাছ পাওয়া যায় (৪)।

বৈজ্ঞানিক নাম ও সমনাম
------------------------------------
হরগজার বৈজ্ঞানিক নাম Acanthus ilicifolius, নামকরণ করেছেন কার্ল লিনিয়াস যাঁকে সংক্ষিপ্তভাবে এল. (L.) অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অন্যান্য সমনাম হলো : Acanthus doloarin (Blanco), Acanthus ilicifolius subsp. orientalis (Bremek.), Acanthus ilicifolius var. subinteger (Nees) ও Dilivaria ilicifolia (L.) (Juss.)

স্থানীয় নাম
------------------------------------
ইংরেজিতে হরগজাকে Holly Mangrove, Shore Purslane, Holly-leaved Acanthus বা Sea Holly বলা হয় (৫)। ভারতেরে পশ্চিম বাংলায় হরগোছ (Hargos), হিন্দিতে বাংলার মতোই হরগজা (Hargoja), সংস্কৃততে হরিকাছা (Harikasa), উড়িয়ায় হরকাঞ্চা (Harakancha), তেলেগুতে আলসি বা আখি (Alsi, Akhi), অস্ট্রেলিয়ায় হোলি ম্যানগ্রোভ (Holy Mangrove), ইন্দোনেশিয়ায় দারুয়্যু বা জেরুজু (Daruyu, Jeruju), মালয়েশিয়ায় (Jeruju hitam), সিঙ্গাপুরে জেরুজু পুটিহ্ (Jeruju Putih), ভিয়েতনামে ত্রোজিক্রান কাপোরসে বা ত্রোজিক্রান স্লেবানলা (Trohjiekcragn Pkaporsvay, Trohjiekcragn Slekbanla) বলা হয়।

ব্যবহার
------------------------------------
ভারতীয় ও চীনা প্রথাগত চিকিৎসা-পদ্ধতিতে হরগজার ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচীন (৬)। হাঁপানি, পক্ষাঘাত ও পঙ্গুত্বের চিকিৎসায় হরগজার মূল ব্যবহৃত হয়। কাশি, সন্ধিবাত ও স্নায়ুশুল উপশমে হরগজার পাতা ব্যবহারের নজির আছে। কচি কাণ্ড ও পাতা সাপে কাঁটার নিরাময়েও ব্যবহার করা হয়। হরগজার মূলের ক্বাথ গড়গড়া করলে দাঁতব্যথা ও মুখের ঘায়ের উপকার হয়। পক্ষাঘাতের চিকিৎসায় হরগজার সিদ্ধ মূলের সঙ্গে সরিষার তেল মিশিয়ে সুন্দরবনের আদিবাসীরা ব্যবহার করে (৭) । বাংলাদেশ সুন্দরবনের বনজীবীরা হরগজার কচিপাতা শাক হিশেবেও ব্যবহার করে থাকে।

সংরক্ষণের অবস্থা
------------------------------------
আইউসিএন-এর বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় (IUCN Red List) হরগজাকে ন্যুনতম বিপদাপন্ন (Least Concern) হিশেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (৮)। পৃথিবীব্যাপী এ প্রজাতির ঘনত্ব ও সংখ্যাগত কোনো সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা না হলেও এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বাদাবনের আয়তন ও ঘনত্ব কমে যাবার কারণে হরগজার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র
------------------------------------
১. https://en.wikipedia.org/wiki/Acanthus_ilicifolius</a>
২. Begum, Momotaz. (2009). Acanthus illcifolius. In Ahmed, Z. U., Hassan, M. A., Begum, Z. N. T., Khondkar, M., Kabir, S. M. H., Ahmad, M., and Ahmed, A. T. A. (eds.). Encyclopaedia of Flora and Fauna of Bangladesh, Vol. 6. Angiosperms: Dicotyledons (Acanthaceae - Asteraceae). Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka. pp 1-2.
৩. Hyland, B. P. M., Whiffin, T., Zich, F. A., et al. (Dec 2010). Factsheet – Acanthus ilicifolius. Australian Tropical Rainforest Plants. Edition 6.1, online version [RFK 6.1]. Cairns, Australia: Commonwealth Scientific and Industrial Research Organisation (CSIRO), through its Division of Plant Industry; the Centre for Australian National Biodiversity Research; the Australian Tropical Herbarium, James Cook University. Retrieved 29 May 2013.
৪. Barker, R. M. (1986). A taxonomic revision of Australian Acanthaceae (pdf). Journal of the Adelaide Botanic Gardens 9: (1–) 64–75 (–286). Retrieved 21 November 2015.
৫. Giesen, W., Wulffraat, S., Zieren, M., and Scholten, L. (2006). Mangrove Guidebook for Southeast Asia. FAO and Wetlands International. FAO Regional Office for Asia and the Pacific. Bangkok. pp 143-186
৬. Pharmacographica indica page 42
৭. Singh, D., and Aeri, V. (2013). Phytochemical and pharmacological potential of Acanthus ilicifolius. DOI: 10.4103/0975-7406.106557. J Pharm Bioallied Sci. 2013 Jan-Mar; 5(1): 17–20
৮. http://www.iucnredlist.org/details/168780/0</a>
Acanthus illcifolius
Acanthus illcifolius
Acanthus illcifolius

প্রদায়ক
---------------------------------
হাসান মেহেদী (mehedi.coastline@gmail.com)

Mangropedia: Free and open-sourced Encyclopedia on Mangroves


Anybody who have internet connection and interested to know about anything in the world, also have clear idea about Wikipedia. People think, let me search in Wikipedia, if want to know detail on any topic - person, species, places, scientific terms or political jargon. Why? What are the major causes behind its wide acceptance? The first cause is 95 percent accuracy of its information [1]. Other causes might be wide range of articles, easily accessible, openness, free of charge, freedom of posting or editing article and articles in local languages. As a result, anybody from any corner of the world can contribute in Wikipedia by writing a new article or by providing new information through editing existing article. At now Wikipedia is available in more than 293 languages and new versions are being developed every day. Many many thanks to initiators of Wikipedia.

How good it would be if we had a dedicated online encyclopedia only on Mangroves? We have mangrove forests all over the world except Europe and they are not less than 158 thousand sq. km. They are like heart of the sea and lungs of the world! They are highly adapted to their environment, capable of excluding or expelling salt, allowing mangroves to thrive in highly saline waters and soils. Many threatened and endangered species inhabit mangrove forests, such as the Bengal tigers, manatees, and sea turtles. Hundreds of bird species have been identified in mangrove forests, and about 75% of all tropical fish and crustaceans spend their lives in mangrove swamps as juveniles. Mangrove forests sequester approximately 1.5 metric tons/hectare/yr of carbon, or 3.7 lbs/acre/day of carbon (1336 lbs/acre/yr). Mangrove substrate may contain 20-25% carbon, which may also help explain the high productivity and biodiversity of these ecosystems. Mangrove forests are also providing (a) protection of associated marine ecosystems; (b) firewood, medicines fibers & dyes, food, charcoal and construction materials; (c) Mangroves have been useful in treating effluent, as the plants absorb excess nitrates and phosphates, thereby preventing contamination of near-shore waters; (d) act as buffers catching materials washed downstream, they help stabilize land elevation by sediment accretion, thereby balancing sediment loss.

Mangrove related information are highly needed for the conservation activists, organizations, tourists and nature lovers, wildlife photographers, school and higher level students, researchers, government institutes and common people. Some of the mangrove forests are declared as World Heritage Sites and Ramsar Sites. But we don't have any single source to know all about mangroves such as flora, fauna, ecology, tourist spots, mangrovers, administrative issues, categories of mangroves, conservation and restoration techniques, organizations working on mangroves, culture of mangrove areas, legendary stories, literatures on mangroves, distribution of mangroves, local name of the mangrove forests, taxonomy, livelihood groups dependant on mangrove forests etc. There is millions of research and study conducted in the world on mangroves, but there is no single source from where we can get all information we need.

So, in many cases we have to search and see several books, reports, articles and papers to know in depth information on any issues about mangroves. It is like searching a black cat in a dark room. It is difficult for even a nature loving tourist to know in-depth information about any mangrove forest, such as the Sundarbans, from any book. The information are scattered even in this very twenty first century although there are some information in Wikipedia and other online encyclopedia on plants or lives. But, still there are problems. Most of the information is for higher level readers, not for students or common people. Higher level readers need technical information and technical terms, but school students and common people cannot understand those. Again, many of the books are written in general languages which have no use at technical level.

So, there should be a source of information where all classes of readers can get required information openly and free of cost. It should be all about mangroves which can be on Mangroves of Guatemala or Balikapan mangrove forest of Indonesia. There should be information about algae of Madagascar which can also be found in Barguna in Bangladesh or Sajnekhali in India. People can search there for information about Dimer Char (Islet of Egg) or Barking Deer. Through this way, readers from all levels can think mangroves as their relatives, not alien. This source should provide information on description of species to honey collectors' life and livelihoods. This wide range of information should have interlinks so that anybody can access to more information on any technical word, name or term.

A group of youth volunteers of CLEAN started translation and adaptation of Marvellous Mangroves Curriculum of Bangladesh in 2013 under financial assistance from Mangrove Action Project (MAP) and Mangroves and Reefs Education Association (MREA) and technical assistance of Martin A. Keeley, Global Education Director of MAP. This 380-page book is actually for science teachers who are teaching environmental science using MM Curriculum and complying with national curriculum. The book contains a number of exercises and games which make their education easy and joyful. But after implementation of one year and more, the teachers and students demand more in-depth and supporting information. The new generation is not happy with paper based book only. They also need support information from online sources as they know how to use internet in their schools and home. It is the driving force to think differently.

But the students are not the only group who need special information on mangroves. People who want to work as conservation or restoration volunteers, tourists who visit mangrove forests every year, wildlife photographer who need population of specific species in a certain area or a researcher who need information on nature and ecology - everybody has specific requirement of information. Each and every requirement is different from others. So, updating articles with latest provided information is also important.

Considering all respective issues a group of lunatic young activists have taken decision to imitate a dedicated online encyclopedia on only mangroves. It is initiated by CLEAN (Coastal Livelihood and Environmental Action Network) in 2015 but contributed by voluntary developers, contributors, editors and scholars and treated as a social resource for all. The word "Mangropedia" is portmanteau of the words Mangro (short form of mangrove) and encyclopedia. Mangropedia will be written collaboratively by anonymous volunteers who write without pay. Anyone with Internet access can write and make changes to Mangropedia articles. Users can contribute anonymously, under a pseudonym, or, if they choose to, with their real identity. Authentic name of the contributor are preferred because it will help to issue a certificate of Volunteer, Contributor or Editor from Mangropedia.

Mangropedia is totally a voluntary initiative. We need suggestions and support from all sector of the world. We believe that suggestion, participation and support from all will contribute to establish and enrich the encyclopedia on Mangroves. Of course, we need financial support for this huge task. But, before that, we need your contribution by writing an article or editing any existing article. Anybody, who has internet connection, can join us as a contributor or editor. Primarily we are trying to develop the English and Bengali version. But versions in other languages will be developed within 2016, as these languages are spoken by the countries where mangrove forests exist [####]. Contributions from all will create a community owned encyclopedia, Mangropedia. Write to:Mangropedia Editor. Visit: Mangropedia Website

----------------------------------------
[1] Sara, J. and Lopes, C. (2010). Statistical Measure of Quality in Wikipedia. 1st Workshop on Social Media Analytics (SOMA ’10), Washington, DC, USA: July 25, 2010

Primary plan is to develop different versions in following languages: Afrikaans, Arabic, Bengali, Burmese, Cebuano, Chinese, Divehi, Dutch, English, French, German, Hindi, Indonesian, Italian, Japanese, Javanese, Khmer, Korean, Malay, Malayalam, Oriya, Persian, Portuguese, Sinhalese, Spanish, Swahili, Tagalog, Tamil, Telugu, Thai, Urdu and Vietnamese

ম্যানগ্রোপিডিয়া : বাদাবন বিষয়ক জ্ঞানকোষ

Mangropedia Logo
ইন্টারনেট সংযোগ আর একটু জানার ইচ্ছা আছে এমন প্রত্যেকেই উইকিপিডিয়া সম্পর্কে জানেন। নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য প্রথমেই ভাবেন, উইকিপিডিয়ায় ঢুঁ মেরে দেখলে কেমন হয়? ছাত্র-শিক্ষক, লেখক-গবেষক সবার কাছেই উইকিপিডিয়ার এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ কী? প্রথম কারণ তো অবশ্যই ৯৫ শতাংশেরও বেশি তথ্যের যথার্থতা। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এর উন্মুক্ত চরিত্র, লেখা ও সম্পাদনা করার স্বাধীনতা, বিনামূল্যে পাবার সুযোগ ও পৃথিবীর নানা ভাষায় এর ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ থাকা। এর ফলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষ তার নিজস্ব ভাষায় উইকিপিডিয়া পড়তে ও সম্পাদনা করতে পারেন। এখন তো বাংলা ভাষায়ও উইকিপিডিয়া রয়েছে। বাংলার তরুণদের এই উদ্যোগ ও অবদানের প্রশংসা না করলে অন্যায়ই হবে। উইকিপিডিয়ার এই বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো ব্যবহার করে ইতোমধ্যে অন্যান্য বিষয়েও উন্মুক্ত জ্ঞানকোষ বা নানা ধরনের পিডিয়া তৈরি হচ্ছে।

কেমন হতো যদি বাদাবন (Mangrove) নিয়েও এমন একটি উন্মুক্ত জ্ঞানকোষ তৈরি করা যেত? আমাদের ঘরের পেছনেই পৃথিবীর সবথেকে বড়ো একক বাদাবন, সুন্দরবন। এছাড়া পুরো উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাদাবনের নানান প্রজাতির গাছপালা, পশুপাখি। সুন্দরবন বাদে যেটুকু বাদাবন অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় আছে তা-ই অন্যান্য বহু দেশের মোট বাদাবনের তুলনায় অনেক বেশি। ২০০১ সালের তথ্য অনুসারে জাপানে বাদাবন আছে মাত্র ৭৫ বর্গ কি.মি আর হংকং-এ মাত্র ২.৮২ বর্গ কি.মি । সেখানে দুই বাংলা মিলিয়ে সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গ কি.মিরও বেশি। আর উদ্ভিদ, শৈবাল, স্তন্যপায়ী প্রাণী, উভচর, সরিসৃপ, মাছ, পাখি মিলে বাদাবন এক বিরাট প্রাণজগত। পৃথিবীর কয়েকটি বড়ো দেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশের মোট প্রাণসম্পদের তুলনায় সুন্দরবনের প্রাণসম্পদ বেশি। তাইতো জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহায়ক সংগঠন ইউনেস্কোর তালিকায় এটা একটা ‘বিশ্বঐতিহ্য স্থান’ আর বিশ্ব জলাভূমি সনদ (রামসার সনদ) ঘোষিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি বা ‘রামসার সাইট’!

কিন্তু চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের বাদাবন বিষয়ক তথ্যাবলীর অবস্থা খুবই দুর্বল। আর সেটা বোঝা যাবে অস্ট্রেলিয়া গায়ানা মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড হংকং বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সামান্য বাদাবনের দেশগুলোর তথ্যকোষগুলোর দিকে তাকালেই! যে কেউ ইন্টারনেটে খোঁজ করলে এসব দেশের প্রতিটি উদ্ভিদ বা প্রাণী প্রজাতি, প্রতিবেশ, পর‌্যটন কেন্দ্র, আবাসন সুবিধা সবকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশের বাদাবন সম্পর্কিত তথ্য পাবার পথগুলো আজকের যুগের প্রেক্ষিতে সত্যিই কঠিন। এ বিষয়ক অনেক গবেষণা হয়েছে বটে, কিন্তু সংশ্লেষণ ও সমন্বয়ের অভাবে নানান ধরনের প্রকাশনার মধ্যে তথ্যগুলো রয়ে গেছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায়। যারা ইন্টারনেট থেকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণীর বিস্তারিত তথ্য পেতে চান, তখন তা সত্যিই অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো হয়ে যায়। এখন পর‌্যন্ত কোনো ব্যবহার-বান্ধব পদ্ধতি দাঁড়ায় নি, যদিও ইংরেজি ও বাংলা উইকিপিডিয়ায় কিছু তথ্য রয়েছে। কিন্তু সেখানে ভাষা ছাড়াও টেকনিক্যাল সমস্যা আছে। উদ্ভিদ ও প্রাণী সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলোয় প্রায়শই প্রচুর ‘পরিভাষা’ ব্যবহার করা হয়। উচ্চস্তরের পাঠকের সেটি খুবই দরকার, কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষের কাছে তা বোধগম্য নয়। আবার সাদামাটা ভাষায় লেখা তথ্যগুলো গবেষক বা উচ্চস্তরের পাঠকদের কোনো উপকার করতে পারে না।

এমন একটি জ্ঞানকোষ থাকা দরকার যা এই দুটি পক্ষেরই উপকারে আসতে পারে; যেখানে বাদাবন বিষয়ক সবকিছু পাওয়া যাবে, সেটা হতে পারে ইন্দোনেশিয়ার ছোট্ট বালিকাপান বাদাবন-পর‌্যটনকেন্দ্র বা কেনিয়ার লামু বাদাবন। থাকা দরকার মাদাগাস্কারের বাদা-জলাভূমির শৈবালের তথ্য যার সঙ্গে মিল আছে বরগুনা বা সজনেখালি বা মাঝের চরের। ডিমের চর থেকে শুরু করে বিলুপ্ত কুকুরে হরিণের তথ্য জানানো দরকার সবাইকে, যাতে বাদাবনকে নিজের আপনজন ভাবতে পারে নতুন প্রজন্ম। এখানে যেন কিশোর-কিশোরী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উভয়েই খুঁজে পান প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম, বসতি থেকে শুরু করে বাদাবনের মৌয়াল বা জোংড়াখোটাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য। বিস্তীর্ণ তথ্যের জালের মধ্যেই থাকা দরকার এক ধরনের পারস্পরিক সামঞ্জস্য যাতে একটি তথ্য থেকে সহজেই সম্পূরক তথ্যে যাওয়া যায় অন্য ওয়েবসাইটে ক্লিক না করে।

নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষা সহজ ও বাদাবন-ভিত্তিক করার জন্য গত ২০১৩ সালে উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন)-এর উদ্যোগে কিছু তরুণ কর্মী “বাংলাদেশের অপরূপ বাদাবন” নামে একটি পাঠ-সহায়ক বই তৈরি করেন। এ বইটি মূলত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য যারা এখান থেকে তথ্য ও ধারণা নিয়ে প্রাকৃতিক ও ভৌত বিজ্ঞান, ভাষাশিক্ষা, সমাজ, ও চারুকলার ক্লাসে ব্যবহার করতে পারবেন। এ বইতে এমন কতোগুলো খেলা আছে যেগুলোর মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোররা বাদাবন ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে জানতে-বুঝতে পারে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তো শুধু পাঠ্য বা পাঠ-সহায়ক বইয়ে সন্তুষ্ট না। তাদের দরকার চলতে-ফিরতে খেলার ফাঁকেও যেন তথ্য পাওয়া যায় এমন উৎস ও মাধ্যম।

কিন্তু তথ্যের চাহিদা শুধু শিক্ষার্থীদেরই না, বরং বাদাবন সংরক্ষণে যাঁরা কাজ করতে চান, যে ৪-৫ লাখ পর‌্যটক প্রতিবছর বাদাবনে বেড়াতে আসেন, প্রকৃতি-আলোকচিত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেন কিংবা যাঁরা প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণা করেন, সকলেরই তথ্যের বিশেষ চাহিদা আছে। প্রত্যেকের চাহিদা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। একেবারে সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য যুক্ত করে তাই তথ্যাবলী হালনাগাদ করার প্রশ্নও থাকে। এ সবকিছু মাথায় রেখে কিছু কিছু তরুণের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে বাদাবনের সব তথ্য নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকোষভিত্তিক ওয়েবসাইট। ম্যানগ্রোভ শব্দটির প্রথমাংশ ও এনসাইক্লোপিডিয়া শব্দটির শেষাংশ নিয়ে তথ্যকোষটির নাম দেয়া হয়েছে ম্যানগ্রোপিডিয়া। বাদাবনের প্রতিবেশ, বিস্তৃতি, সংস্কৃতি, উদ্ভিদ প্রাণী ও অণুজীব পরিচিতি, বাদাবন-সমৃদ্ধ দেশগুলোর তালিকা, পরিবেশবাদীদের জীবনী, পরিবেশবাদি সংগঠনের পরিচিতি, বাদাবন-নির্ভর জনগোষ্ঠীগুলোর বিবরণ, বাদাবনে পর‌্যটন ইত্যাদি বিষয় তুলে আনা হচ্ছে ম্যানগ্রোপিডিয়ায়। উইকিপিডিয়ার মতো বিষয় লিখে খোঁজার পাশাপাশি বিষয়ের ধরন অনুসারেও ম্যানগ্রোপিডিয়ায় প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া পাওয়া যাবে আদ্যাক্ষর অনুযায়ীও। এটিই ম্যানগ্রোপিডিয়ার সবথেকে বড়ো সুবিধা।

সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতেই ম্যানগ্রোপিডিয়া গড়ে উঠছে। তবে আমরা সকলের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করি, কেননা সবার পরামর্শ, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায়ই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ একটি বাদাবনভিত্তিক জ্ঞানকোষ। উইকিপিডিয়ার মতোই ইন্টারনেট সংযোগ আছে এমন যে কেউ ম্যানগ্রোপিডিয়া উন্নয়নের কাজে যোগ দিতে পারেন। এখন শুধুমাত্র বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এ বছরই ইংরেজি বা বাংলার পাশাপাশি যেসব দেশে বাদাবন আছে তার সব ভাষাতেই ম্যানগ্রোপিডিয়ার সংস্করণ তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। এখন পর‌্যন্ত যেসব ভাষা নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হলো : আফ্রিকান, আরবি, বাংলা, বার্মিজ, সেবুয়ানো, চায়নিজ, ডিবেহি, ডাচ, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান (বাহাসা), ইতালিয়ান, জাপানিজ, জাভানিজ, খেমের, কোরিয়ান, মালয়, মালয়ালাম, উড়িয়া, ফার্সি, পর্তুগীজ, সিংহলিজ, স্প্যানিশ, সোয়াহিলি, তাগালগ, তামিল, তেলেগু, থাই, উর্দু ও ভিয়েতনামিজ।

সকলের লেখা নিয়ে গড়ে উঠবে ম্যানগ্রোপিডিয়া। ম্যানগ্রোপিডিয়ায় লেখার জন্য প্রত্যেক প্রদায়কের নাম ও সংক্ষিপ্ত জীবনী দেয়া থাকবে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধটির নিচেই। এছাড়া ১০টি নিবন্ধ লেখার (হতে পারে অনুবাদ, বৃক্ষ পরিচিতি বা বাদাবন বিষয়ক যে কোনো বিষয়) পর একজন নিবন্ধকার পাবেন স্বীকৃতির সনদপত্র। উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিবছর ম্যানগ্রোপিডিয়ানদের সম্মেলন আয়োজনেরও। আর ম্যানগ্রোপিডিয়া পরিচালনা বিষয়ক যে কোনো স্দ্ধিান্তও নিবেন প্রদায়ক (কনট্রিবিউটর), সম্পাদক (এডিটর) ও ওয়েব ডেভেলপারদের প্রতিনিধিবৃন্দ। ম্যানগ্রোপিডিয়ায় আপনার নিবন্ধ জমা দেবার জন্য লিখুন editor@mangropedia.org বরাবর। ক্লিন-এর সহযোগিতায় দাঁড় করানো হচ্ছে এর প্রাথমিক ভিত্তি। ম্যানগ্রোপিডিয়ার ঠিকানা : www.mangropedia.org