Mangropedia Logo |
ইন্টারনেট সংযোগ আর একটু জানার ইচ্ছা
আছে এমন প্রত্যেকেই উইকিপিডিয়া সম্পর্কে জানেন। নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য প্রথমেই ভাবেন,
উইকিপিডিয়ায় ঢুঁ মেরে দেখলে কেমন হয়? ছাত্র-শিক্ষক, লেখক-গবেষক সবার কাছেই উইকিপিডিয়ার
এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ কী? প্রথম কারণ তো অবশ্যই ৯৫ শতাংশেরও বেশি তথ্যের যথার্থতা।
অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এর উন্মুক্ত চরিত্র, লেখা ও সম্পাদনা করার স্বাধীনতা, বিনামূল্যে
পাবার সুযোগ ও পৃথিবীর নানা ভাষায় এর ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ থাকা। এর ফলে পৃথিবীর যে
কোনো প্রান্তের মানুষ তার নিজস্ব ভাষায় উইকিপিডিয়া পড়তে ও সম্পাদনা করতে পারেন। এখন
তো বাংলা ভাষায়ও উইকিপিডিয়া রয়েছে। বাংলার তরুণদের এই উদ্যোগ ও অবদানের প্রশংসা না
করলে অন্যায়ই হবে। উইকিপিডিয়ার এই বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো ব্যবহার করে ইতোমধ্যে অন্যান্য
বিষয়েও উন্মুক্ত জ্ঞানকোষ বা নানা ধরনের পিডিয়া তৈরি হচ্ছে।
কেমন হতো যদি বাদাবন (Mangrove)
নিয়েও এমন একটি উন্মুক্ত জ্ঞানকোষ তৈরি করা যেত? আমাদের ঘরের পেছনেই পৃথিবীর সবথেকে
বড়ো একক বাদাবন, সুন্দরবন। এছাড়া পুরো উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাদাবনের নানান
প্রজাতির গাছপালা, পশুপাখি। সুন্দরবন বাদে যেটুকু বাদাবন অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় আছে
তা-ই অন্যান্য বহু দেশের মোট বাদাবনের তুলনায় অনেক বেশি। ২০০১ সালের তথ্য অনুসারে জাপানে
বাদাবন আছে মাত্র ৭৫ বর্গ কি.মি আর হংকং-এ মাত্র ২.৮২ বর্গ কি.মি । সেখানে দুই বাংলা
মিলিয়ে সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গ কি.মিরও বেশি। আর উদ্ভিদ, শৈবাল, স্তন্যপায়ী
প্রাণী, উভচর, সরিসৃপ, মাছ, পাখি মিলে বাদাবন এক বিরাট প্রাণজগত। পৃথিবীর কয়েকটি বড়ো
দেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশের মোট প্রাণসম্পদের তুলনায় সুন্দরবনের প্রাণসম্পদ বেশি। তাইতো
জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহায়ক সংগঠন ইউনেস্কোর তালিকায় এটা একটা ‘বিশ্বঐতিহ্য
স্থান’ আর বিশ্ব জলাভূমি সনদ (রামসার সনদ) ঘোষিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি বা ‘রামসার
সাইট’!
কিন্তু চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে
তুলনা করলে আমাদের বাদাবন বিষয়ক তথ্যাবলীর অবস্থা খুবই দুর্বল। আর সেটা বোঝা যাবে অস্ট্রেলিয়া
গায়ানা মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড হংকং বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সামান্য বাদাবনের
দেশগুলোর তথ্যকোষগুলোর দিকে তাকালেই! যে কেউ ইন্টারনেটে খোঁজ করলে এসব দেশের প্রতিটি
উদ্ভিদ বা প্রাণী প্রজাতি, প্রতিবেশ, পর্যটন কেন্দ্র, আবাসন সুবিধা সবকিছু সম্পর্কে
স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশের বাদাবন সম্পর্কিত তথ্য পাবার পথগুলো আজকের
যুগের প্রেক্ষিতে সত্যিই কঠিন। এ বিষয়ক অনেক গবেষণা হয়েছে বটে, কিন্তু সংশ্লেষণ ও সমন্বয়ের
অভাবে নানান ধরনের প্রকাশনার মধ্যে তথ্যগুলো রয়ে গেছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায়। যারা ইন্টারনেট
থেকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণীর বিস্তারিত তথ্য পেতে চান, তখন তা সত্যিই অন্ধকারে
হাতড়ানোর মতো হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবহার-বান্ধব পদ্ধতি দাঁড়ায় নি, যদিও ইংরেজি
ও বাংলা উইকিপিডিয়ায় কিছু তথ্য রয়েছে। কিন্তু সেখানে ভাষা ছাড়াও টেকনিক্যাল সমস্যা
আছে। উদ্ভিদ ও প্রাণী সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলোয় প্রায়শই প্রচুর ‘পরিভাষা’ ব্যবহার করা হয়।
উচ্চস্তরের পাঠকের সেটি খুবই দরকার, কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষের
কাছে তা বোধগম্য নয়। আবার সাদামাটা ভাষায় লেখা তথ্যগুলো গবেষক বা উচ্চস্তরের পাঠকদের
কোনো উপকার করতে পারে না।
এমন একটি জ্ঞানকোষ থাকা দরকার যা
এই দুটি পক্ষেরই উপকারে আসতে পারে; যেখানে বাদাবন বিষয়ক সবকিছু পাওয়া যাবে, সেটা হতে
পারে ইন্দোনেশিয়ার ছোট্ট বালিকাপান বাদাবন-পর্যটনকেন্দ্র বা কেনিয়ার লামু বাদাবন।
থাকা দরকার মাদাগাস্কারের বাদা-জলাভূমির শৈবালের তথ্য যার সঙ্গে মিল আছে বরগুনা বা
সজনেখালি বা মাঝের চরের। ডিমের চর থেকে শুরু করে বিলুপ্ত কুকুরে হরিণের তথ্য জানানো
দরকার সবাইকে, যাতে বাদাবনকে নিজের আপনজন ভাবতে পারে নতুন প্রজন্ম। এখানে যেন কিশোর-কিশোরী
এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উভয়েই খুঁজে পান প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম, বসতি থেকে শুরু
করে বাদাবনের মৌয়াল বা জোংড়াখোটাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য। বিস্তীর্ণ তথ্যের জালের মধ্যেই
থাকা দরকার এক ধরনের পারস্পরিক সামঞ্জস্য যাতে একটি তথ্য থেকে সহজেই সম্পূরক তথ্যে
যাওয়া যায় অন্য ওয়েবসাইটে ক্লিক না করে।
নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর
শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষা সহজ ও বাদাবন-ভিত্তিক করার জন্য গত ২০১৩ সালে উপকূলীয়
জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন)-এর উদ্যোগে কিছু তরুণ কর্মী “বাংলাদেশের অপরূপ
বাদাবন” নামে একটি পাঠ-সহায়ক বই তৈরি করেন। এ বইটি মূলত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য
যারা এখান থেকে তথ্য ও ধারণা নিয়ে প্রাকৃতিক ও ভৌত বিজ্ঞান, ভাষাশিক্ষা, সমাজ, ও চারুকলার
ক্লাসে ব্যবহার করতে পারবেন। এ বইতে এমন কতোগুলো খেলা আছে যেগুলোর মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোররা
বাদাবন ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে জানতে-বুঝতে পারে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তো শুধু পাঠ্য
বা পাঠ-সহায়ক বইয়ে সন্তুষ্ট না। তাদের দরকার চলতে-ফিরতে খেলার ফাঁকেও যেন তথ্য পাওয়া
যায় এমন উৎস ও মাধ্যম।
কিন্তু তথ্যের চাহিদা শুধু শিক্ষার্থীদেরই
না, বরং বাদাবন সংরক্ষণে যাঁরা কাজ করতে চান, যে ৪-৫ লাখ পর্যটক প্রতিবছর বাদাবনে
বেড়াতে আসেন, প্রকৃতি-আলোকচিত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেন কিংবা যাঁরা প্রকৃতি-প্রতিবেশ
নিয়ে গবেষণা করেন, সকলেরই তথ্যের বিশেষ চাহিদা আছে। প্রত্যেকের চাহিদা অন্যদের চেয়ে
ভিন্ন। একেবারে সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য যুক্ত করে তাই তথ্যাবলী হালনাগাদ করার প্রশ্নও
থাকে। এ সবকিছু মাথায় রেখে কিছু কিছু তরুণের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে বাদাবনের
সব তথ্য নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকোষভিত্তিক ওয়েবসাইট। ম্যানগ্রোভ শব্দটির প্রথমাংশ
ও এনসাইক্লোপিডিয়া শব্দটির শেষাংশ নিয়ে তথ্যকোষটির নাম দেয়া হয়েছে ম্যানগ্রোপিডিয়া।
বাদাবনের প্রতিবেশ, বিস্তৃতি, সংস্কৃতি, উদ্ভিদ প্রাণী ও অণুজীব পরিচিতি, বাদাবন-সমৃদ্ধ
দেশগুলোর তালিকা, পরিবেশবাদীদের জীবনী, পরিবেশবাদি সংগঠনের পরিচিতি, বাদাবন-নির্ভর
জনগোষ্ঠীগুলোর বিবরণ, বাদাবনে পর্যটন ইত্যাদি বিষয় তুলে আনা হচ্ছে ম্যানগ্রোপিডিয়ায়।
উইকিপিডিয়ার মতো বিষয় লিখে খোঁজার পাশাপাশি বিষয়ের ধরন অনুসারেও ম্যানগ্রোপিডিয়ায় প্রয়োজনীয়
তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া পাওয়া যাবে আদ্যাক্ষর অনুযায়ীও। এটিই ম্যানগ্রোপিডিয়ার সবথেকে
বড়ো সুবিধা।
সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতেই
ম্যানগ্রোপিডিয়া গড়ে উঠছে। তবে আমরা সকলের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করি, কেননা সবার
পরামর্শ, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায়ই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ একটি বাদাবনভিত্তিক জ্ঞানকোষ। উইকিপিডিয়ার
মতোই ইন্টারনেট সংযোগ আছে এমন যে কেউ ম্যানগ্রোপিডিয়া উন্নয়নের কাজে যোগ দিতে পারেন।
এখন শুধুমাত্র বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এ বছরই
ইংরেজি বা বাংলার পাশাপাশি যেসব দেশে বাদাবন আছে তার সব ভাষাতেই ম্যানগ্রোপিডিয়ার সংস্করণ
তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। এখন পর্যন্ত যেসব ভাষা নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হলো :
আফ্রিকান, আরবি, বাংলা, বার্মিজ, সেবুয়ানো, চায়নিজ, ডিবেহি, ডাচ, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান,
হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান (বাহাসা), ইতালিয়ান, জাপানিজ, জাভানিজ, খেমের, কোরিয়ান, মালয়,
মালয়ালাম, উড়িয়া, ফার্সি, পর্তুগীজ, সিংহলিজ, স্প্যানিশ, সোয়াহিলি, তাগালগ, তামিল,
তেলেগু, থাই, উর্দু ও ভিয়েতনামিজ।
সকলের লেখা নিয়ে গড়ে উঠবে ম্যানগ্রোপিডিয়া। ম্যানগ্রোপিডিয়ায়
লেখার জন্য প্রত্যেক প্রদায়কের নাম ও সংক্ষিপ্ত জীবনী দেয়া থাকবে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধটির
নিচেই। এছাড়া ১০টি নিবন্ধ লেখার (হতে পারে অনুবাদ, বৃক্ষ পরিচিতি বা বাদাবন বিষয়ক যে
কোনো বিষয়) পর একজন নিবন্ধকার পাবেন স্বীকৃতির সনদপত্র। উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা রয়েছে
প্রতিবছর ম্যানগ্রোপিডিয়ানদের সম্মেলন আয়োজনেরও। আর ম্যানগ্রোপিডিয়া পরিচালনা বিষয়ক
যে কোনো স্দ্ধিান্তও নিবেন প্রদায়ক (কনট্রিবিউটর), সম্পাদক (এডিটর) ও ওয়েব ডেভেলপারদের
প্রতিনিধিবৃন্দ। ম্যানগ্রোপিডিয়ায় আপনার নিবন্ধ জমা দেবার জন্য লিখুন editor@mangropedia.org বরাবর। ক্লিন-এর সহযোগিতায় দাঁড় করানো হচ্ছে এর প্রাথমিক
ভিত্তি। ম্যানগ্রোপিডিয়ার ঠিকানা : www.mangropedia.org।